মূলধন সংকটে মার্কিন ব্যাংক খাত

যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যর্থতার ইতিহাসে সম্প্রতি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। দেশটির স্থানীয় সময় ১০ মার্চ সকালে ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ (এসভিবি) বন্ধ ঘোষণা করে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। ১২ মার্চ নিউইয়র্কভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বন্ধ ঘোষণার পর ব্যাংক দুটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। ব্যাংকের সম্পত্তি বিক্রি করে সেই অর্থ গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হবে। পরপর দুই ব্যাংক বন্ধের ঘোষণায় ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক খাতের এ ধাক্কা খুব সহজেই কাটছে না।

প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেছিল সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। আমেরিকার বন্ডেই এই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির হার কমাতে ফেডারেল রিজার্ভ গত বছর সুদের হার বাড়াতে শুরু করে, যার ফলে বন্ডের দর কমে যায়। স্টার্টআপগুলোও করোনা মহামারির পর থেকে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা সঞ্চিত অর্থ তুলে নেয়। গ্রাহকদের টাকার জোগান দিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করতে হয়। ফলে অচিরেই ব্যাংকের তহবিলে টান পড়ে।

মূলত ৮ মার্চ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের চাকা বন্ধের উপক্রম হয়। তারা ঘোষণা দেয়, লোকসানের কারণে বড় সংখ্যক শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। ব্যালেন্সশিটে ঘাটতি মোকাবিলায় নতুন করে আরও ২২৫ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করা হতে পারে। 

এরপরই ভেনচার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোর মাঝে তোড়জোড় দেখা দেয়। এসব কোম্পানি আগেই ব্যাংকটি থেকে এর গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধের পরপরই আরও কিছু স্থানীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ব্যাপক দরপতন হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুঁজিবাজারে। ১০ মার্চ সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের শেয়ারের দর কমেছে ১৫ শতাংশ। সপ্তাহের হিসাবে ব্যাংকটির শেয়ারের দরপতন হয়েছে অন্তত ৩৪ শতাংশ। একই দিন অ্যারিজোনাভিত্তিক ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্স ব্যানকর্পের শেয়ারের দর নেমে গিয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বরের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এ ছাড়া প্যাকওয়েস্ট ব্যানকর্পের শেয়ারের দরপতন হয় ৩৮ শতাংশ। 

অথচ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্লারাভিত্তিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক গত বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের র‌্যাংকিংয়ে ১৬তম স্থানে ছিল। ওই সময় পর্যন্ত তাদের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। 

প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের আকস্মিক পতন নির্দিষ্ট কারণেই হয়েছে। গত বছর থেকে ক্রমাগতভাবে সুদের হার বাড়িয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সংকট বাড়ছিল। সুদের হার বাড়ায় আমানত হারাচ্ছিল ব্যাংকটি। ট্রেজারি থেকে তাদের প্রায় ১৮০ কোটি ডলার কমে গিয়েছিল। মূলধন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়েও তারা ব্যর্থ হয়।

২০০৮ সালে সর্বশেষ আর্থিক সংকটে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব। ওই সময় দেউলিয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ২০০৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক’ বন্ধের ঘটনাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। ১৫ বছরের মাথায় সেই সংকট ফের দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যাংক বন্ধের ঘটনা ঘটে গত ১০ মার্চ। এর তিন দিনের মধ্যে তৃতীয় ব্যাংক হিসেবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সিগনেচার ব্যাংককে। তিন দিনের মধ্যে পরপর দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বের আর্থিক খাতে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই সংকট বিশ্ব বাজারেও জোরেশোরে ধাক্কা দেয়। আটকে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি মার্কিন ডলার। 

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের আর্থিক পরিষেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত বছর শেষে সিগনেচার ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৩৬ কোটি ডলারের। আর ব্যাংকটিতে আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮৫৯ কোটি ডলার। বার্তা সংস্থাটির অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিগনেচার ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার পরিবারের সদস্যদের। তাদের বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে অর্থায়নও করেছিল ব্যাংকটি।

এদিকে পরপর দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের ঘাড়ে নতুন করে কোনো চাপ আসবে না বলে জানিয়েছে রাজস্ব বিভাগ। অর্থাৎ এসভিবি ও সিগনেচার ব্যাংককে সরকারের পক্ষ থেকে বেইল আউট বা পুনরুদ্ধার করা হবে না। তবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছে রাজস্ব বিভাগ। ৮ থেকে ১০ মার্চের মধ্যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকটি শেয়ার মার্কেটে হারিয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ। আর ইউরোপিয়ান ব্যাংকগুলো হারিয়েছে পাঁচ হাজার কোটি ডলার। 

২০০৮ সালে সংকটের পরেই ব্যাংকিং খাতে নতুন করে নিয়মনীতি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এতে করে যে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা দেউলিয়া হলেও এর প্রভাব গোটা অর্থনীতিতে পড়বে না। ওইসব নীতির পরে প্রথমবারের মতো কোনো ব্যাংক বন্ধ হলো। এফডিআইসির ঘোষণা অনুযায়ী, ১৩ মার্চ থেকে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ সব শাখা খোলা রয়েছে। যেসব আমানতকারী বীমার আওতাধীন রয়েছেন তারা তাদের অর্থ পাবেন। এফডিআইসির তথ্যমতে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ৮৯ শতাংশ গ্রাহক বীমার আওতাধীন ছিল না। ওই ৮৯ শতাংশ গ্রাহকের ব্যাংকটিতে জমা ছিল ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বীমা ছাড়া এসব গ্রাহকের অর্থের কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

এসভিবির মতো সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোষণাটিও এসেছে অনেকটা আকস্মিকভাবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও ১২ মার্চ নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে সিগনেচার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক বৈঠকে উপস্থিত হন কর্মীরা। তবে ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা প্রধান কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান। সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও রাজস্ব বিভাগ ও ফেডারেল রিজার্ভের এক যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, মার্কিন অর্থনীতি সুরক্ষিত ও নাগরিকদের আস্থা ধরে রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় এফডিআইসি সিগনেচার ব্যাংকের সব হিসাব ফিফথ থার্ড ব্যাংক করপোরেশনে স্থানান্তর করেছে। ১৩ মার্চ থেকেই গ্রাহকেরা সেখানে তাদের হিসাব ব্যবহার করতে পারছেন।

মার্কিন এ ব্যাংক সংকট নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ফেসবুকে পোস্টে লিখেছেন, ‘এ বছর আর্থিক খাতের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য যে তিনজন অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তারা সবাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। শুধু উন্নত দেশের জন্যই নয়, স্বল্পোন্নত দেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের গবেষণা থেকে দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে। এর আগেও আর্থিক খাতের বিশ্লেষণের জন্য ১৯৯৭ সালে দুজন এবং ২০১৩ সালে তিনজন অর্থনীতিবিদকে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ওই সব বিশ্লেষণ শেয়ার বাজারের বিপর্যয় ঠেকাতে বা এ নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিতে খুব কাজে দেয়নি বলে মনে করা হয়। কারণ শেয়ার বাজারের কেনাবেচার ধরন শুধু অর্থনীতির যৌক্তিক আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, যে কারণে স্নায়ু-অর্থনীতি বা নিউরো-ইকোনমিক্স নামে নতুন ধারার অর্থনীতি নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা আমানত রাখার তেমন কোনো বিকল্প নেই বলে ব্যাংক খাতের সমস্যা সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না; কিন্তু যখন কোনো বিপর্যয় ঘটে তখন তার জন্য পুরো অর্থনীতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়। এবারের নোবেল পুরস্কার অনেক দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য হুঁশিয়ারি বার্তা বহন করে এনেছে।’

প্রসঙ্গত এবার তিন মার্কিন অর্থনীতিবিদ বেন বারনাঙ্কে, ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডাইবভিগ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটি জানায়, এই তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণা সমাজ কীভাবে আর্থিক সংকট মোকাবিলা করে তা বুঝতে সাহায্য করে। বিশেষ করে তাদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ব্যাংক ধস ঠেকানো কেন জরুরি সেটা তারা দেখিয়েছেন। সংকটকালীন অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতের গুরুত্ব এবং ব্যাংকের পতন ঠেকানো কেন জরুরি তা ওই গবেষণায় উঠে এসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //