জাপানি নীতির প্রভাব পড়বে বিশ্ববাজারে

করোনাকালের ধকল ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি জাপানও এর বাইরে নয়। তবে জাপানের সংকটের শুরুটা আরও আগে থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ব্যাংক অব জাপান) সংকট সমাধানে বিশ্বব্যাপী জাপানের কেনা বন্ড বিক্রি ও বিদেশে বিনিয়োগ কমিয়ে আনার নীতি গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ব্যাংক অব জাপানের গভর্নর হারুহিকো কুরোদা বৈশ্বিক বিনিয়োগ ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণায় বিশ্ব বাজারের গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে। ২০১৬ সালে কুরোদা বন্ড কেনা বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তখন জাপানের অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মূল্যের বৈশ্বিক বিনিয়োগের পাহাড় গড়ে উঠেছিল। জাপানি বিনিয়োগকারীরা হলেন মার্কিন সরকারি বন্ডের সবচেয়ে বড় বিদেশি ক্রেতা এবং ব্রাজিলের ঋণ থেকে শুরু করে ইউরোপীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত জাপানি বিনিয়োগকারীরা সবক্ষেত্রেই এগিয়ে।

ব্ল্যাকরক ইনভেস্টমেন্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান এবং ব্যাংক অব কানাডার সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিন বোইভিন বলেন, ‘জাপানে নীতির পরিবর্তন হলো একটি অত্যন্ত শক্তিশালী পদক্ষেপ। যখন আপনি একটি মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন বা নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন, তখন এটি চ্যালেঞ্জিং ও অগোছালো হতে পারে। এর চেয়ে বড় কথা হলো, এরপর কী হবে।’

প্রসঙ্গত, ফ্লো রিভার্সাল প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত বছর জাপানি বিনিয়োগকারীরা রেকর্ড পরিমাণ বিদেশি সম্পদ বিক্রি করেছেন। কুরোদা গত ডিসেম্বরে আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন। তখন তিনি জাপানি বন্ডের ওপর লভ্যাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, জাপানি সরকারের বন্ডগুলো বিক্রি হয়। আর ইয়েন হয় আকাশচুম্বী। মার্কিন ট্রেজারি থেকে অস্ট্রেলিয়ান ডলার পর্যন্ত সবকিছুকেই তা ধাক্কা দেয়।

ম্যান জিএলজি গ্রুপের পোর্টফোলিও ম্যানেজার জেফরি আথারটন বলেন, ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে যে, বিদেশে বিনিয়োগকৃত অর্থ জাপানে ফেরত আসছে। তিনি আরও বলেন, ওই বিনিয়োগকারীদের ডলারের বিপরীতে ইয়েনের বিনিময় হারে পতন মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াতে সহায়তা করছে। এজন্য অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি না নেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত হবে।

মূল্যস্ফীতির চাপে কমেছে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের মান। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ধীরগতির কারণে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইয়েনের দরপতন নিয়ে সংকটে পড়েছে জাপান। মূলত জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নীতি সুদহারের পার্থক্যের কারণে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের দরপতন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক খুচরা বিক্রেতা খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে মূল্যস্ফীতির দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাংক অব জাপানের (বিওজে) মুদ্রানীতি সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে মন্দার ঝুঁকি এবং মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে অন্ধকারে রয়ে গেছে। 

মূল্যস্ফীতির কারণে জাপানে সাধারণ মানুষেরা জীবনযাত্রার খরচ কমিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। গত ফেব্রুয়ারিতে জাপানের ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। জানুয়ারিতে চার দশকের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির পর গত মাসে কিছুটা কমেছে। উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ে ভর করে গত জানুয়ারিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর-পরবর্তী সর্বোচ্চ। ফেব্রুয়ারিতে ৩ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ব্যাংক অব জাপান (বিওজে) নির্ধারিত ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি। 

মূল্যস্ফীতির কারণে দেশটির পণ্য আমদানি আরও ব্যয়বহুল হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যয়ের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। জাপানে দাম বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে মোট ১২ হাজার ৫৪টি পণ্য। গড়ে এসব পণ্যের দাম ১৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি। গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ দ্বিগুণ। ২০২২ সালের প্রথম চার মাসে ৫ হাজার ৫৭৩ পণ্যের দাম বেড়েছিল। এর বিপরীতে শুধু জানুয়ারি মাসেই হিমায়িত খাদ্য ও সামুদ্রিক খাদ্যের মোট ৫ হাজার ৪৬৩ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। গত অক্টোবরে ৭ হাজার ৮০০টি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছিল। মার্চে ২ হাজার ৭১৬টি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এপ্রিলের দিকে বাড়বে ৩ হাজার ১৯২টি পণ্যের।

১০৫টি নিবন্ধিত ও ৯০টি অনিবন্ধিত খাদ্য ও পানীয় প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া এক অর্থনৈতিক জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছে, গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত প্রতি মাসেই দুই-তিন হাজার পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির দৌরাত্ম্যে বেড়ে যাবে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচও। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খরচ।

এদিকে বিওজে পরিচালিত ‘তানকান’ সমীক্ষায় জাপানের বৃহৎ উৎপাদনকারীদের ব্যবসায়িক মনোভাব নেতিবাচক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, রপ্তানি কমে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার উদ্বেগের কারণে টানা পাঁচটি ত্রৈমাসিকে এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বিওজে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত ৯ হাজারেরও বেশি কোম্পানির মতামত এই সমীক্ষায় নিয়েছে। বৃহৎ উৎপাদনকারীদের ব্যবসায়িক মনোভাবের উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখা জরিপটিতে সূচকটি দাঁড়ায় প্লাস ১-এ, যা গত ডিসেম্বর মাসে পরিচালিত জরিপের চেয়ে ছয় পয়েন্ট কম।

একটি ধণাত্মক সংখ্যা ইঙ্গিত করে যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার তুলনায় আরও বেশি কোম্পানি ব্যবসার অবস্থা ভালো বলে মনে করছে। উপকরণের ব্যয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির উদ্বেগের পাশাপাশি, স্মার্টফোন এবং পিসিতে ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা দুর্বল হওয়ার কারণে মনোভাব প্রভাবিত হয়েছে।

এদিকে বৃহৎ অনুৎপাদনশীল কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। তাদের সূচক এক বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২০-এ পৌঁছেছে, যা টানা চতুর্থ ত্রৈমাসিক ধরে উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। 

বিওজের জরিপে গাড়ির উৎপাদনে গতি বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কমে আসার প্রত্যাশায়, পরবর্তী ত্রৈমাসিকে বৃহৎ উৎপাদনকারীদের মনোভাবে ২ পয়েন্ট উন্নতির পূর্বাভাস করা হয়েছে। তবে শ্রমিক ঘাটতির কথা বিবেচনা করে বহু অনুৎপাদনশীল শিল্পের সঙ্গে জড়িত কোম্পানির মনোভাবে পাঁচ পয়েন্ট অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া অধিক উপাদান ব্যয়ও নির্মাণ এবং রিয়েল এস্টেট শিল্পের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগে সহজীকরণ নীতি কার্যকর করার পর থেকে বিওজে ৩.৫৫ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বন্ড কিনেছে। ব্রিটিশ সাবেক মন্ত্রী ও গোল্ডম্যান শ্যাস গ্রুপ ইনকরপোরেটেডের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল এ নীতি সম্পর্কে বলেন, ‘প্রায় নিশ্চিতভাবেই এটি ইয়েনের একটি উল্লেখযোগ্য পতনে অবদান রেখেছে, জাপানি বন্ড মার্কেটের ব্যাপক স্থবিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

এই ধীরস্থির ভাবের কারণ এই নয় যে সরকারের পরিকল্পনা সফল হতে যাচ্ছে। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এই দেখে যে এমন কৌশলের কারণে জাপানের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লাভের মুখ দেখতে হিমশিম খাচ্ছে।

নেতিবাচক সুদের হারের কারণে ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। বিপুল পরিমাণের সম্পদ কেনার ফলে বন্ডের আকর্ষণীয় বাজারেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে জাপান বড় কোনো অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে সেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে নাও পেতে পারে বলে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মন্তব্য। সার্বিকভাবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এ দেশটির অর্থনীতি যখন সংকুচিত হচ্ছে, এর প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //