গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে জনগণ

এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে গর্ভপাত বিষয়ে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তা ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে দেশটির ৫৬% শতাংশ মানুষ মনে করে। গত ১৩ এপ্রিল বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং গবেষণা সংস্থা ‘ইপসস’-এর করা এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

রয়টার্স বলছে, এই জরিপের ফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মার্কিন জনগণ বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার উপর ব্যাপকভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই মতামত ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের উপরে প্রভাব ফেলবে তা প্রায় নিশ্চিত। আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘মিফেপ্রিসটাইন’ নামক গর্ভপাত ঘটানো ওষুধ, যা একসময় মার্কিন সরকার বিক্রি করা অবৈধ ঘোষণা করেছিল, তা এখন বিক্রি করা যাবে।

রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচারের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা নির্বাচিত হলে গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করবেন, অথবা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। ২০২২ সালের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনায় গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করার পর অনেকেই আদালতের রুলিংকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে আখ্যা দিয়েছিল। আর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের নির্বাচনে আশানুরূপ বিজয় অর্জন না করার কারণ হিসেবে সেই রুলিংকে অনেকেই উল্লেখ করেছিলেন। 

এক মাস আগে রয়টার্স ও ‘ইপসসের আরেক জরিপে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন জনগণের অর্ধেকই বিশ্বাস করে, ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী পর্নোতারকাকে অর্থ দিয়ে চুপ থাকতে বলেছিলেন কিনা, সে ব্যাপারে সরকারি যে তদন্ত চলেছে, তা মূলত রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। এমনকি ডেমোক্র্যাট ঘরানার এক-তৃতীয়াংশও সেটাই ভেবেছিল। বিচার ব্যবস্থার উপর মার্কিন জনগণের আস্থার অভাবটা অবশ্য নতুন নয়।

২০২২ সালের জুন মাসে গবেষণা সংস্থা গ্যালাপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৩ সাল থেকে তারা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের উপর জনগণের আস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়ে আসছে। সেখানে দেখা যায়, ১৯৮৫ ও ১৯৮৮ সালে ৫৬ শতাংশ মানুষের আস্থাই ছিল বিচার ব্যবস্থার উপরে জনগণের সর্বোচ্চ আস্থা। আর কখনোই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। আর ২০০২ সালের পর থেকে তা নিম্নগামী। ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৩০ শতাংশ জনগণের আস্থা পেলেও ২০২২ সালের জুনে তা ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে; যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। 

শুধু বিচার ব্যবস্থাই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অংশ মিডিয়ার উপরেও জনগণের আস্থা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। গত জুলাই মাসে গ্যালাপের এক জরিপে বলা হয়, মাত্র ১৬ শতাংশ মার্কিন জনগণ সংবাদপত্র এবং মাত্র ১১ শতাংশ টেলিভিশনের খবরের তথ্য বিশ্বাস করে থাকে; যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। গ্যালাপ বলেছে, ১৯৭৯ সালে এই বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। কিন্তু ১৯৮১ সাল থেকে তা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। ২০০৬ সালের পর থেকে উভয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাই ৩০ শতাংশের নিচে চলে আসে; আর ২০২০ সাল থেকে তা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। 

মার্কিন সরকারের উপরে আস্থাও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালের জুনে গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৫৮ সালে মার্কিন সরকারের উপরে ৭৩ শতাংশ জনগণের আস্থা ছিল; যা ১৯৬৪ সালে ৭৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তা পড়তে থাকে। ১৯৮০-এর দশকে রোনাল্ড রিগ্যানের সময়ে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ; ১৯৯১ সালে জর্জ বুশ সিনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ; আর ২০০১ সালে জর্জ বুশ জুনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ মানুষের আস্থা থাকলেও ২০০৮ সালের পর থেকে বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের সময়ে তা কখনোই ২৫ শতাংশের উপরে ওঠেনি। 

শুধু সরকারই নয়, পুরো সরকার ব্যবস্থার উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। গত ৭ এপ্রিল পিউ রিসার্চের প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, জনগণের ৫৬ শতাংশ মনে করছে না, রাষ্ট্র তাদের বড় সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম। শুধু প্রেসিডেন্টের অধীনে প্রশাসনই নয়, উভয় দলের কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টের উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। শুধু তাই নয়; জনগণের ৭৬ শতাংশ মনে করে না, মার্কিনিদের সক্ষমতা রয়েছে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এছাড়া জনগণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও ভালো চোখে দেখছে না। ৪৬ শতাংশ জনগণ আশঙ্কা করছে, আসন্ন বছরে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। 

মার্কিন জনগণের রাষ্ট্রীয় ভিতগুলোর উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা যথেষ্টই গভীর। মার্কিন থিঙ্কট্যাক র‍্যান্ড কর্পোরেশনের এক প্রতিবেদনে এটাকে ‘ট্রুথ ডেকে’ বা সত্যের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে সত্য ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব কমে গেছে। মানুষ বিভিন্ন বিশ্লেষণকে বিশ্বাস করতে পারছে না; যার ফলে রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে।

এগুলোর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মানুষ এখন প্রচলিত তথ্যের উৎসের উপরে নির্ভর না করে সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নির্ভর করছে। এছাড়াও রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মার্কিনিরা এখন ব্যাপকভাবে বিভক্ত; যা কিনা তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু সত্যের উপরে স্থির না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় যে কোনো সমস্যা, তা কোভিড-১৯ হোক, দারিদ্র্য, অভিবাসন, জলবায়ুই হোক, সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //