‘গোপন নথি’ প্রকাশে অস্বস্তিতে মার্কিন প্রশাসন

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনার অতি গোপনীয় নথি ফাঁস হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিত্র দেশের রাজনৈতিক নেতা, কর্মকর্তা, এমনকি বিচারকদের ওপর মার্কিন নজরদারির বিষয়টি আবারও সামনে এলো। নথি ফাঁসের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন জো বাইডেন প্রশাসন। 

মার্চ মাসের শুরু থেকে বা তারও আগে অতি গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা নথি একের পর এক ইন্টারনেটে ফাঁস হয়েছে। এসব নথি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে মার্কিন সরকারের গভীর সম্পৃক্ততা এবং ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নিবিড় নজরদারির কথা ফাঁস করে দিয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় প্রচারের পর এ ঘটনা পেন্টাগনের ‘লিক গেট’ হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে, যা ২০১৩ সালে উইকিলিকসের গোপন তথ্য ফাঁসের পর সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা।

মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন গত ১০ এপ্রিল জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথি ফাঁস দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘মারাত্মক’ ঝুঁকির বিষয়। ফাঁস হওয়া নথিতে ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সম্পর্কিত স্পর্শকাতর তথ্য রয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ‘লিক গেট’ সম্পর্কে বলেন, তিনি গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের এক মাস পর বিষয়টি জানতে পেরেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য প্রকাশকারীদের খুঁজে বের করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর কথাও তিনি উল্লেখ করেন। 

কোন উৎস থেকে নথিগুলো ফাঁস হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে তদন্ত শুরু হয়েছে। এসব নথি প্রথমে টুইটার ও টেলিগ্রামের মতো আরও কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনেক বিস্তৃত তথ্যের পাশাপাশি ফাঁস হওয়া এসব নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের বিষয়ে স্পর্শকাতর ব্রিফিংয়ের উপাদান থাকার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। ফাঁস হওয়া অন্য নথিগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। পেন্টাগন, হোয়াইট হাউস ও সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিচার বিভাগও এই ফাঁসের ঘটনাটি এখন তদন্ত করে দেখছে। 

নথি ফাঁসের অভিযোগে গত ১৩ এপ্রিল মার্কিন বিমানবাহিনীর এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য ২১ বছর বয়সী জ্যাক টাশেরাকে গ্রেপ্তার করে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। আদালতে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ দুটি হলো-জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক তথ্য অবৈধভাবে নিজের কাছে রাখা ও ছড়িয়ে দেওয়া এবং গোপন তথ্য ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক নথিপত্র অনুমোদন ছাড়া সরিয়ে নেওয়া। প্রথম অভিযোগটি প্রমাণ হলে টাশেরার সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। অপরদিকে দ্বিতীয় অভিযোগের পরিণতি হতে পারে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।

গোপন নথিগুলো প্রথম ফাঁস করা হয় বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ ডিসকর্ডের একটি চ্যাট গ্রুপে। ওই গ্রুপ পরিচালনা করতেন টাশেরা। আদালতে এফবিআইয়ের জমা দেওয়া নথিপত্রে বলা হয়েছে, টাশেরা প্রথমে গোপন নথিগুলোর ছোট ছোট অংশ চ্যাট গ্রুপটিতে প্রকাশ করতেন। পরে গত জানুয়ারিতে নথিগুলোর ছবি তুলে প্রকাশ করা শুরু করেন তিনি। তবে ফাঁস হওয়া নথিগুলো চ্যাট গ্রুপের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টি টের পাননি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের কর্মকর্তারা। বিষয়টি জানার পরই তারা নথি ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির সন্ধানে নামেন।

ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত নথিতে দেখানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর সার্বিক নজরদারি করে। মার্কিন ফাঁস হওয়া নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বসন্তকালে যে আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করতে চলেছে, শেষ পর্যন্ত তা কোনো ফলাফল দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা। ইউক্রেনের প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো-অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকট এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা। ইউক্রেন সোভিয়েত আমলের অস্ত্রশস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং তাদের গোলাবারুদের মজুদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র খুব ধীরগতিতে সরবরাহ করা হচ্ছে।

ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এই অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করতে সময়ও লাগছে। ইউক্রেনে যে পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন, সেই পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন পশ্চিমাদের নেই। রাশিয়ার সুরক্ষিত প্রতিরক্ষার বিপরীতে পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে ইউক্রেনের। এ বাস্তবতায় ইউক্রেন তাদের বসন্তকালীন পাল্টা আক্রমণে বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে না বলেই ধারণা করা হয় ওই নথিতে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন হলো, ইউক্রেনের দিক থেকে পরিচালিত কোনো পাল্টা আক্রমণে যুদ্ধের বাঁকবদল হবে না। এই যুদ্ধ আরও কয়েক বছর স্থায়ী হবে। কেউ কেউ মনে করছেন, এই যুদ্ধ অনন্তকাল ধরে চলবে।

মিত্র দেশে নজরদারি

কয়েক দশক ধরে মিত্রদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বিচার নজরদারি হলো ওপেন সিক্রেট। ফাঁস হওয়া নথিগুলোর মধ্যে একটি নথি দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে। তারিখবিহীন ওই নথিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সঙ্গে শীর্ষ সহযোগীদের মধ্যে কথিত অভ্যন্তরীণ আলোচনার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সিউলকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। সিউলের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে তা ইউক্রেনে পাঠাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিলে তা দক্ষিণ কোরিয়ার দীর্ঘদিনের নীতি ভঙ্গ করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার নীতি অনুযায়ী, যুদ্ধরত কোনো দেশে অস্ত্র রপ্তানি করা যায় না।

নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে এ নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তাদের আলোচনার পর উভয় পক্ষই ফাঁস হওয়া ওই নথির বিষয়টিকে বানোয়াট বলে মত দিয়েছেন। তবে নথির কোন অংশ অসত্য, তা স্পষ্ট করেননি তারা। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নজরদারির ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে একে দেশের সার্বভৌমত্বে স্পষ্ট লঙ্ঘন ও ইউন প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যর্থতা হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে। কথিত ফাঁস হওয়া নথি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি মিত্রদেশের ওপর নজরদারির অভিযোগ উঠেছে। এ তালিকায় ইসরায়েলের নামও রয়েছে।

মিশরীয় কর্মকর্তা পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথিকে ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন। ওই নথিতে দাবি করা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ৪০ হাজার রকেট উৎপাদন করে রাশিয়ায় পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল মিশর। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির দেশটির শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তারা রাশিয়াকে রকেটের পাশাপাশি কামানের গোলা ও বারুদ সরবরাহের বিষয়েও আলোচনা করেন। ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে’ এই পরিকল্পনার কথা গোপন রাখতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সিসি।

পরাশক্তির মোহে নজরদারি

যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একমেরু বিশ্বব্যবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। বহুকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে ভীষণভাবে। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, যার সঙ্গে জড়িত রাশিয়া। চীন ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে। আরও শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার পথে মার্কিন মিত্ররা চীন-রাশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। আর এ অনিরাপত্তা থেকেই নজরদারির ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হয়েছে। নজরদারি আস্তে আস্তে এক ধরনের প্রয়োজনীয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।

তা ছাড়া নজরদারিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক হাত দিয়ে আকাশ ঢেকে সারা বিশ্বে মুনাফা অর্জনের একটি মাধ্যম। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক পরিচালক জেমস উলসি স্বীকার করেছেন, প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় এয়ারবাস গ্রুপ থেকে সৌদি আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ডার জিততে বোয়িংকে সাহায্য করেছে সিআইএ। এর আগে সিআইএর প্রিজম প্রকল্পে নজরদারির তথ্য ফাঁস করেছিলেন রাশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন। 

উইকিলিকসের তথ্য ফাঁস গোটা দুনিয়ার ক্ষমতালিপ্সু শাসকদের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। এই নথিগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সরকারের ভয়ংকর কুকর্ম, নজরদারি ও যুদ্ধাপরাধের মতো বিষয় প্রকাশ্যে এনেছে, যা হয়তো উইকিলিকস প্রকাশ না করলে অন্য কোনোভাবে কোনোদিনই প্রকাশ পেত না। মার্কিন নজরদারি ও দেশে দেশে আগ্রাসন যেমন চলছে, এর প্রতিক্রিয়াও থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //