ডলার যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতির শঙ্কা

গত কয়েক বছরে মার্কিন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনের উত্থান, করোনা কাল এবং ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন বিশ্ব বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে বিভিন্ন জোট ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ডলারে লেনদেন বন্ধ হয়েছে। অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করছে। এখনো বিশ্ববাজারে লেনদেনের প্রধান মুদ্রা ডলার। তবে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন আধিপত্য যেমন খর্ব হচ্ছে, তেমনি ডলারেরও আর আগের সেই একচ্ছত্র সাম্রাজ্য নেই।

আন্তর্জাতিক লেনদেনের কেন্দ্রীয় মুদ্রা হলেও মার্কিন ও বিশ্ববাজারে ডলারের পরিমাণ কত হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। অন্য কেউ এর পরিমাণ নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলতে পারে না। ফলে তারা নিজেদের সুবিধামতো ডলার বাজারে ছাড়তে পারে। নতুন ডলার বাজারে এলে মুদ্রাস্ফীতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই হয় না-বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব পড়ে। 

২০০৮ সালে আর্থিক সংকট এবং ২০২০-২১ সালে করোনাকালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য প্রচুর ডলার, ইউরো, পাউন্ড বাজারে ছেড়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে, যার প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী। তবে অন্য মুদ্রার চেয়ে বিশ্ববাসী ডলারের জন্য অনেক বেশি সংকট অনুভব করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো মুখোমুখি হয় অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির। ১৯৭০-এর দশকের জ্বালানি সংকটের পর এত ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখেনি পৃথিবী।

প্রসঙ্গত সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরিশোধিত তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (ওপেক) সঙ্গে তেল বাণিজ্য করে থাকে, তাকে পেট্রোডলার বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থার ভিত ভেঙে পড়লে স্বর্ণের মজুদের ওপরে ডলারের নির্ভরতার দিন শেষ হয়ে যায়, ডলার পরিণত হয় কাগুজে মুদ্রা কিংবা ‘ফিয়াট কারেন্সি’তে। অন্যদিকে স্বর্ণের বিকল্প হয়ে ওঠে খনিজ তেল, তা বিশ্ব বাজারে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ হিসেবে পরিচিত। 

১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবকে তাদের সব পেট্রোলিয়াম পণ্য, অর্থাৎ শোধিত তেল, খনিজ তেল ও গ্যাস একমাত্র মার্কিন ডলারে বিক্রি করার প্রস্তাব দেন, যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সৌদি আরবকে পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে। সে সময়ে প্রথমে সৌদি আরব এবং পরে অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে এবং এর মধ্য দিয়ে পেট্রোডলারের যাত্রা শুরু হয়।

সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পণ্য সরবরাহ সংকটের সঙ্গে ডলারের বাড়তি দাম যোগ হয়ে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ভীষণভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জ্বালানি তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়। খাদ্য উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়েছে; তেমনি বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। রাশিয়ার ওপর ন্যাটো ও জি৭-ভুক্ত দেশগুলোর ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ এবং বিশ্ববাণিজ্যিক লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দু সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার ফলে পৃথিবীর একাদশতম অর্থনীতির দেশ রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় ৫০টি দেশের বাণিজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ডলারকে ব্যবহার করা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে রাখা ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রাশিয়ান আমানত ব্যবহার করতে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের মুদ্রা রুবলে তেল কিনতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়া রুবলে লেনদেন হচ্ছে ইরান, চীন, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা, আর্মেনিয়া এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে। ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাওয়া রুবলের দাম আবার বেড়ে যায়। এখন রাশিয়ার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশের অধিক সম্পন্ন হচ্ছে রুবলে। বিশ্ববাণিজ্যে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে রুবল। চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়া থেকে রুবলে তেল ও গ্যাস কিনছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর রাশিয়া সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে থাকে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্র্যাটেজিস্ট ডেভিড উ বিবিসিকে বলেন, ‘রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলার নিয়ে অনেক দেশ ভাবতে শুরু করেছে। রাশিয়া ডলারের বদলে রুবলে লেনদেনের চেষ্টা করছে। চীনও বৈদেশিক বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করছে, কারণ তারাও চিন্তা করতে শুরু করেছে, কোনোদিন যদি তাদের অবস্থা রাশিয়ার মতো হয়, তখন কী হবে? ফলে অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের চেষ্টা করছে।’

বৈশ্বিক লেনদেন ও বৈদেশিক মজুদ সংরক্ষণে বিকল্প মুদ্রাগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন ডলার কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, যেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডি-ডলারাইজেশন’। রাশিয়ার অর্থায়নে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, সেটার ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে। সৌদি আরব থেকে আগামীতে নিজস্ব মুদ্রায় জ্বালানি তেল কেনার আগ্রহের কথা জানিয়েছে চীন। এ বিষয়ে সৌদি সরকার সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। চীন ঋণও দিতে চায় না ডলারে। মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে ঋণ দিতে প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। ঋণের পুরোটা অথবা আংশিক তারা ইউয়ানে দেবে। 

সম্প্রতি চীন সফরের সময় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা চীনের সঙ্গে ডলার বাদ দিয়ে নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন করার ঘোষণা দিয়েছেন। সৌদি আরব থেকে ইউয়ান ব্যবহার করে তেল কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে চীন। এর মধ্যেই তারা ফ্রান্সের টোটাল এনার্জির সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন শুরু করেছে। ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে ইরান, চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুরসহ ১৮টি দেশের সঙ্গে রূপিতে লেনদেনের একটি চুক্তি করেছে ভারত। এরই মধ্যে ব্রিকস জোট ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন একটি বৈশ্বিক মুদ্রা চালুর কথা ভাবছে। আর সম্ভাব্য সেই মুদ্রার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আরও ২৪টি দেশ। 

ইয়াহু ফাইন্যান্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের বাড়তি দরের কারণে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রার ভাণ্ডারে ডলারের অংশীদারত্ব কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে; ২০২১ সালে যা ছিল ৫৫ শতাংশ। রিজার্ভে ও লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া মুদ্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপের ইউরো, রাশিয়ার রুবল, চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি ইত্যাদি।

এদিকে মজুদ ও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিশ্বজুড়ে এখন সোনার কদর বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য রেলেভেন্স অব গোল্ড অ্যাজ আ স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে কৌশলগত সম্পদ, নিরাপদ বিনিয়োগ ও বিলাসি পণ্য হিসেবে সোনা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে সোনার ভূমিকা জোরদার হচ্ছে। বিশ্বে ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সোনায় বিনিয়োগে বছরে প্রায় ৮ শতাংশ হারে মুনাফা হয়েছে। এতটা লাভ ইক্যুইটি, বন্ড ও অন্যান্য পণ্যে পাওয়া যায়নি। ডব্লিউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ ঝুঁকির সময়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার ভূমিকা ঐতিহ্যগতভাবেই ভালো। ডব্লিউজিসি জানায়, ২ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বছরগুলোয়ও বিশ্বে সোনার দাম ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যমানের সোনা কেনাবেচা হয়েছে। বিশ্বে বিনিয়োগকারী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ সোনা মজুদ আছে, তার মূল্যমান ৪.৮ ট্রিলিয়ন বা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার।

তবে এখনো ডলারের বিকল্প কোনো বৈশ্বিক মুদ্রার খোঁজ মেলেনি। ইউরো ইউরোপের অনেকগুলো দেশের একক মুদ্রা হলেও এসব দেশের অর্থনীতিতে আলাদা নীতি আছে। সব দেশের অর্থনীতিও একরকম নয়। ফলে ইউরোর পক্ষে সারা বিশ্বের একটি মুদ্রা হয়ে ওঠা অনেক চ্যালেঞ্জের। চীনের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা সেটা চায় না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের মতে, চীনের মুদ্রা এখনো পুরোপুরি বৈশ্বিক পরিসরে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হয়ে ওঠেনি। চীন তাদের মূলধন ধরে রাখতে চায়, অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চীনা মুদ্রা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারবে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের মতো করে কোনো দেশ নিজেদের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে চলতি হিসাবের বিশাল ঘাটতি তৈরি হবে। আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্র্যাটেজিস্ট অর্থনীতিবিদ ডেভিড উ বলেন, চীনের মতো রফতানিনির্ভর দেশগুলো কখনো চাইবে না, ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার মান বেড়ে যাক। সেটা হলে তাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক একই কারণে সেটা করতে চায় না জাপানের মতো দেশও। ফলে ডলারের জৌলুস কমে গেলেও বিশ্ববাজারে মুদ্রাটি অর্বাচীন হয়ে পড়ছে না অচিরেই। তবে ডলার আধিপত্য খর্ব হওয়াকে মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য বড় শঙ্কার কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //