মণিপুরে সহিংসতার নেপথ্যে

বিজেপিশাসিত ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগত সহিংসতায় অন্তত ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সহিংসতা দমে এলেও রাজ্যজুড়ে থমথমে অস্থির অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। তবে জাতিগত এ সংঘর্ষের ইতিহাসও মণিপুরে নতুন নয়। সর্বশেষ তিন দশক আগে কুকি-জোমি পাহাড়ি আদিবাসীদের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি সম্প্রদায়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। তবে এবারের সহিংস বাস্তবতা আরও জটিল। আর সেটি ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। 

মেইতি সম্প্রদায়ভুক্ত মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার গত কয়েক বছরে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ে পপিক্ষেতের বিশাল অংশ ধ্বংস করেছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সংরক্ষিত বন থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করেছে। এটি আদিবাসীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কুকিদের অভিযোগ, তাদের কয়েকটি গির্জা ও অনেক বাড়ি নিয়ম মেনে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ওই অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেইতি সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি তফসিলি আদিবাসী জাতিভুক্ত (এসটি) হওয়া। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরের সমতলের বাসিন্দা মেইতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠীর বিরোধ চলছে। সম্প্রতি মণিপুর হাইকোর্ট মেইতি সম্প্রদায়কে তফসিলি জাতিভুক্তদের তালিকায় আনা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন। এরপরই নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য। এটি আদিবাসীদের আতঙ্কিত করেছে, কারণ ‘সাধারণ’ থেকে এসটি হয়ে উঠলে মেইতিরা চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এসটিদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি সুবিধায় ভাগ বসাবেন।

আদালতের নির্দেশের প্রতিবাদে গত ৩ মে চূড়াচাঁদপুর জেলার তোরবাঙে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর’ (এটিএসইউএম) আদিবাসী সংহতি পদযাত্রার ডাক দেয়। সেখান থেকে সহিংসতার সূত্রপাত। ৩ মে রাতেই ইম্ফল পশ্চিম, কাকচিং, থৌবাল, জিরিবাম ও বিষ্ণুপুর জেলা এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তানিয়ন্ত্রিত চূড়াচাঁদপুর, কাংপোকপি ও তেংনুপাল জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। একই সঙ্গে রাজ্যে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি ৪ মে সন্ধ্যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ জারি করেন রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকে। এ নির্দেশে বলা হয়, চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে, যখন আর কোনো উপায় কাজে আসবে না, সেই সময় দেখামাত্র গুলি চালানো যেতে পারে। ৫ মে রাতে নতুন করে সহিংসতার ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৬ মে এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পিটিআই জানিয়েছে, চূড়াচাঁদপুর জেলার হাসপাতালের মর্গে ১৬টি ও পূর্ব ইম্ফল জেলার জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে ১৫টি মরদেহ রয়েছে। পশ্চিম ইম্ফল জেলার লেমফেলের দ্য রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে রয়েছে ২৩টি মরদেহ।

মণিপুরে ১৬টি জেলা রয়েছে। তবে গোটা রাজ্যকে সাধারণত ‘উপত্যকা’ এবং ‘পাহাড়’- এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, থৌবাল, বিষ্ণুপুর ও কাকচিংয়ের আজকের উপত্যকা জেলাগুলো নিংথৌজা রাজবংশ দ্বারা শাসিত কাংলেইপাকের আগের রাজ্যের অংশ ছিল। অনেক ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ বলেছেন, উপত্যকার বাইরের আদিবাসী অঞ্চলগুলোও এই রাজ্যের অধীনে ছিল। তবে আদিবাসীদের জন্য ওই অঞ্চলগুলোয় সমস্যা তৈরি হতো। বিশেষ করে নাগাদের জন্য।

মণিপুর উপত্যকাটি নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে ছড়িয়ে পড়া নিচু পাহাড়ের প্রান্ত দ্বারা বেষ্টিত। মণিপুরের ভৌগোলিক অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে গঠিত এই পাহাড়ি এলাকা। যেখানে রয়েছে ১৫টি নাগা জাতিসত্তা এবং চিন-কুকি-মিজো-জোমি জনগোষ্ঠীর বাস। কাংলেইপাক সে সময় ছিল একটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য। এর উত্তরের পাহাড় থেকে নেমে আসা নাগাদের দ্বারা বারবার রাজ্যটি আক্রান্ত হয়। মণিপুরের ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেইতি ও নাগাদের মধ্যে একটি বাফার হিসেবে কাজ করা এবং উপত্যকাকে লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বার্মার কুকি-চিন পাহাড় থেকে কুকি-জোমিদের এনেছিলেন বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। নাগাদের মতো কুকিরাও যোদ্ধা জাতি। যাদের মণিপুরের মহারাজা পাহাড়ের ধারে জমি দিয়েছিলেন। যাতে তারা নিচে ইম্ফল উপত্যকার জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারেন।

পার্বত্য জনগোষ্ঠী ও মেইতিদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে নাগা জাতীয় আন্দোলনের আবির্ভাবের পর একটি স্বাধীন নাগা রাষ্ট্রের আহ্বানের মধ্য দিয়ে এই সংঘর্ষ বাড়তে শুরু করে। মেইতি ও কুকি-জোমির মধ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানের মাধ্যমে সে সময় নাগা বিদ্রোহ মোকাবিলা করা হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে, এনএসসিএন-আইএম সশস্ত্রগোষ্ঠী যখন স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আরও জোর দেয়, তখন কুকি-জোমি গোষ্ঠীগুলোরও সামরিকীকরণ শুরু হয়। কুকিরা সে সময় স্বাধীন ‘কুকিল্যান্ড’-এর জন্য নিজস্ব আন্দোলন শুরু করে। তবে নাগা আন্দোলনের বিপরীতে, কুকি-জোমির আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল ভারতের মধ্যে একটি রাজ্য গঠনের। যদিও কুকিরা মেইতি সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসেবেই কাজ শুরু করেছিল; কিন্তু কুকিল্যান্ডের দাবি এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি করে।

১৯৯৩ সালে নাগা-কুকি সংঘর্ষের সময়, এনএসসিএন-আইএম সদস্যরা অভিযোগ করেন, তারা নাগাদের অন্তর্গত গ্রামে গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকে কুকি বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়েছিল। অনেক কুকি সে সময় কুকি-জোমি অধ্যুষিত জেলা চূড়াচাঁদপুরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন, চূড়াচাঁদপুর জেলায় কুকিরা জড়ো হওয়ায় তাদের নিরাপত্তার অনুভূতি বেড়েছে। স্বাধীন অঞ্চলের জন্য নাগা ও কুকি আন্দোলনের জেরে মেইতি জাতীয়তাবাদ উজ্জীবিত হয়। যার জেরে মণিপুর উপত্যকায় অসংখ্য গ্রুপের জন্মও হয়। ১৯৭০-এর দশকে জনসংখ্যার পরিবর্তন এবং ঐতিহ্যবাহী মেইতি এলাকায় জনসংখ্যা সঙ্কুচিত হওয়ায় মেইতিদের লোকজন উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে তাদের জন্য তফসিলি জাতির মর্যাদার দাবি, সেই সময়ও অনেকটাই নিঃশব্দ ছিল।

২০০১ সালে নাগাল্যান্ড ছাড়া অন্যান্য রাজ্যে আইএমের সঙ্গে ভারত সরকারের যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মণিপুরে ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দেয়। ইম্ফলে বিক্ষোভকারীরা বিধানসভা ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। এসটি মর্যাদার দাবি তখন থেকেই একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। মেইতিদের মধ্যে যারা এসটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হতে চান, তারা দুটি যুক্তি তুলে ধরেছেন- এক. অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো আর্থিকভাবে দুর্বল অনেক মেইতি আছেন, যারা ‘সাধারণ’ বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় অসুবিধায় পড়েন। দুই. আঠারো শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু ধর্ম, বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের আগে তারাও আদিবাসী ছিলেন। তাদের সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তারা শুধু প্রকৃতিবাদী ধর্ম ‘সনমাহিজম’ ছেড়ে একটি প্রধান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এতে তাদের আদিবাসী সত্তা বদলে যায় না। তবে পাহাড়ি আদিবাসীদের মতে, মেইতিদের এসব যুক্তি এসটির জন্য বরাদ্দ সরকারি সুবিধাগুলো হস্তগত করার অজুহাত মাত্র। মেইতিরা দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেছেন; এখন পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের প্রাপ্য সম্পদেও ভাগ বসাতে চায়।

পার্বত্য এলাকায় পপি বাগান ধ্বংসের বিষয়টি জাতিগত সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে। মণিপুরে বিজেপির প্রথম মেয়াদ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন থেকে মণিপুর সরকার পাহাড়ে হাজার হাজার একর পপি বাগান ধ্বংস করে চলছে। জমি ও জীবিকা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় কয়েকটি গির্জা ভেঙে ফেলার হয়। এতে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক রং পায়। তাই অনেকের পক্ষে চলমান সহিংসতাকে হিন্দু মেইতি বনাম খ্রিষ্টান আদিবাসী সংঘাতরূপে বর্ণনা করা সহজ হয়। কুকি, নাগাসহ বিভিন্ন আদিবাসী- যারা অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন, তারা একই ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হন এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী প্রতিবাদ’ গড়ে তোলেন। বিজেপি সরকার এ সাম্প্রদায়িকতা গড়ে উঠতে দিয়ে কার্যত নিজেদের কাজটাই করেছে।

এবারের সহিংসতায় সরকারের ব্যর্থতা যেমন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই; তেমনি গির্জা ভাঙার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক রং মাখানো হিন্দুত্ববাদী অবস্থানও নতুন কিছু নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সমীর দাশ বিবিসিকে বলেছেন, ‘পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলো থেকে যেভাবে মানুষ আসছে মণিপুরে, তার জন্য মেইতিরাও বিপন্ন বোধ করছেন। কৃষির ক্ষেত্রে জমি অন্যের হাতে চলে যেতে পারে, স্থানীয়রা চাকরির বাজার হারাবেন- এসবের জন্যই তারা তফসিলি জাতি তকমা নিয়ে সংরক্ষণ পেতে চাইছে। আবার মেইতেইরা তফসিলি জাতিভুক্ত হয়ে গেলে পাহাড়িদের শঙ্কিত হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। সেজন্যই তারা মণিপুরের নানা জায়গায় প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। কিন্তু তার যে একটা পাল্টা প্রতিক্রিয়া হবে মেইতিদের দিক থেকে, সেটাও তো কারও অজানা ছিল না। তাহলে সেক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নিল না কেন- এটা তো সরকারের ব্যর্থতা।’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //