সৌদি অর্থনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া

বছরের পর বছর উৎপাদনশীল খাতে অগ্রসর হতে না পারায় সৌদি আরব ক্রমেই অন্যান্য দেশ থেকে পিছিয়ে পড়েছে। কয়েক বছর আগে দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছিল দেশটির। এর মূলে ছিল তেল-নির্ভর অর্থনীতি। পূর্ববর্তী এ অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে সৌদি আরব। অর্থনীতি বহুমুখী করার পথে হাঁটছে দেশটি। এ লক্ষ্যে ব্যাপক শিল্পায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

এ ছাড়াও মানব সম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে যেসব মৌলিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; তারই ধারাবাহিকতায় নারী শিক্ষা, নারীদের সবরকম অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণসহ ধর্মীয় রক্ষণশীল অবস্থান থেকে সরে আসা, কূটনীতি ও ভূরাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। 

সৌদি আরবের অর্থনীতিতে ক্রমেই বাড়ছে শিল্প খাতের অবদান। জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিল্প, পর্যটন এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের মতো খাতগুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটির সরকার। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে সৌদি যুবরাজ ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছিলেন। 

এটি ২০১৬ সালের কথা। এরপর থেকেই অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার প্রতিফলন এখন দৃশ্যমান। এরই মধ্যে দেশটিতে ফার্মাসিউটিক্যালস, অটোমোবাইলস, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য উৎপাদনসহ নানা শিল্প খাত বিকশিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি সরকার। 

আর এ বিনিয়োগে তাদের সবচেয়ে বড় অংশীদার চীন। গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সৌদি আরব সফরে প্রাথমিকভাবে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা এসপিএ জানিয়েছে, চীন ও সৌদির সংস্থাগুলো নিরাপদ জ্বালানি (গ্রিন এনার্জি), তথ্য প্রযুক্তি, ক্লাউড পরিষেবা, পরিবহন, নির্মাণ ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের ৩৪টি চুক্তি স্বাক্ষর করে। পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে নতুন বৈশ্বিক অংশীদারত্ব জোরদারে তৎপর সৌদি আরব।

সফরকালে সৌদি আরবের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে শি জানান, আরব বিশ্ব, উপসাগরীয় আরব দেশগুলো ও সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ‘নতুন যুগ’ শুরু করতে একটি ‘সূচনা সফরে’ সেখানে গিয়েছেন তিনি। চীন ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি’ অবলম্বন করবে বলেও জানান তিনি। চীনের সংবাদ মাধ্যম সিসিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই মনোভাব পোষণ করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি ‘মানবাধিকারের নামে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের’ বিরোধী।

সৌদি আরবে শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। সরকারি তথ্যমতে, দেশটিতে প্রায় ১০ হাজারের বেশি শিল্পকারখানা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যমতে, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাপক উন্নয়ন করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ৭০ শতাংশ নাগরিক কাজ করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এতে করে চাপ বাড়ে দেশটির সরকারি কোষাগারে। তাই বেসরকারি খাতকে আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে, বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিচ্ছে সরকার।

সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে অর্ধেকই ৩০ বছরের কম। এর বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। তাই অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে হলে নারীদের এর বাইরে রাখার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে তরুণদের প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি প্রশাসন।

সম্প্রতি ১৮ লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তহবিল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)। সেই সঙ্গে এর সম্পদের আকার বাড়িয়ে ৪ ট্রিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ১ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণার সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পিআইএফের গভর্নর ইয়াসির আল রুমাইয়ান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পিআইএফ পাঁচ লাখের বেশি কর্মসংস্থান করেছে। 

এ সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮ লাখে উন্নীত করা পিআইএফের উদ্দেশ্য।’ তিনি আরও জানান, বর্তমানে পিআইএফের ব্যবস্থাপনাধীন মোট সম্পদের পরিমাণ ২ লাখ কোটি রিয়ালের বেশি। ২০২৫ সালের মধ্যে এ পরিমাণ দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে পিআইএফ।

তেল ও গ্যাসের পর সৌদি আরবের অন্যতম আয়ের উৎস হলো হজ খাত। প্রতিবছর হজের উদ্দেশ্যে ২০ থেকে ২৫ লাখ মুসলমান মক্কায় যান। হজ ও ওমরাহ থেকে যে আয় হয়, সেই আয়ের ৪০ শতাংশ আসে হজ পালনকারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। হজ পালনকারীরা যে উপহার কেনেন, তার মাধ্যমে আসে ১৫ শতাংশ আর খাদ্য ও অন্যান্য সেবা প্রদানের মাধ্যমে হয় ১০ শতাংশ আয়। 

মক্কা চেম্বার অব কমার্সের তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিদের হজ পালন করতে খরচ পড়ে গড়ে ৪ হাজার ৬০০ ডলার। সৌদি নাগরিকদের খরচ পড়ে দেড় হাজার ডলার। তবে হজ-ওমরাহকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে দেশটি।

সৌদি আরব এখন বিপুলসংখ্যক বিদেশি পর্যটক টানার জন্য একগুচ্ছ বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান দিরিয়াকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প এবং লোহিত সাগরের তীরের স্মার্ট মেগাসিটি নিয়োম গড়ে তোলা। সৌদি আরব এখন ক্রীড়া ও বিনোদনজগতের মহাতারকাদের নিজেদের দেশে নিয়ে আসছে। তাদের এই সফরের অভিজ্ঞতা বিশ্বকে নতুন ধারণা দেবে বলে ধারণা করা হয়। 

পর্যটনকে উৎসাহিত করতে সম্প্রতি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি সরকার। ২০১৯ সালে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এক রুমে থাকতে হলে কোনো বিদেশি নারী-পুরুষকে বিয়ের সনদ দেখাতে হবে না। তবে সৌদি নাগরিকদের জন্য তা কার্যকর হবে না। আগের মতোই প্রমাণ দেখাতে হবে। সৌদি নাগরিকসহ যে কোনো নারী হোটেলে একা চেক-ইনের সময় শুধু নিজের পরিচয়পত্র দেখালেই হবে। 

নারীরা এমন কাপড় পরবেন যেন তাদের কাঁধ ও হাঁটু ঢাকা থাকে। এখন সৌদি আরবে নারীদের গোটা শরীর কালো বোরকায় আবৃত করে রাখা বাধ্যতামূলক নয়। সংস্কারমূলক আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিশেষ করে নারীদের বিষয়ে তাদের আইনে কিছুটা শিথিলতা উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি এবং কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়। 

এ বছর সৌদি সামরিক বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নারী শিক্ষার প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন পরিবর্তনগুলো ২০৩০ সাল নাগাদ ১০ কোটি পর্যটককে আকৃষ্ট করবে বলে আশা করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, তেলকেন্দ্রিক অর্থনীতির জন্য ২০১৬ সালে যখন তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে যায়, তখন ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়ে সৌদি আরব। সে বছর দেশটির বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরবের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্জিত হতো তেল রপ্তানি থেকে; কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে বিশ্ববাজারে কমতে থাকে তেলের দাম। দেশটির এই আয়ে ধাক্কা লাগে। 

তেলের দাম কমতে থাকায় ২০১৫ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭৩৭ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৬৪০ বিলিয়ন ডলার হয়। সরকার নগদ সংরক্ষণ করতে নির্মাণ খাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে, যা ওই খাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এ ছাড়াও বাজেট ঘাটতি পূরণে আরও ব্যয় সংকোচন নীতি নিতে হয় দেশটিকে। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা নেয় সৌদি সরকার। ওই বছরই গ্রহণ করা হয় ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //