চীন-মিয়ানমার সম্পর্কের মূলে বাণিজ্য

মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশটির সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমাগত বাড়ছে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও চীনের অপরিহার্য মিত্রই বলা যেতে পারে মিয়ানমারকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে এ সম্পর্ক প্রায়ই ‘পাউক ফাউ’ বা একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। দেশ দুটির মধ্যে দুই হাজার ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।

গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও বিদ্যমান। তবে ১৯৮৮ সালের পর দুই দেশের সম্পর্ক এক ভিন্ন রূপ লাভ করে। এ সময় বেইজিং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিবেশীর বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে ওঠে এবং এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। অভ্যুত্থানের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো নেপিদোর ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে তা সত্ত্বেও সামরিক জান্তা যে টিকে আছে বহাল তবিয়তে, এর কারণও চীন।

স্বাধীনতাকামী জাতিগত গোষ্ঠীকে অস্ত্র প্রদান, ঋণের ভীতি বা অস্থিতিশীল প্রকল্প নিয়ে চীনের প্রতি যে মিয়ানমার বরাবরই সন্তুষ্ট ছিল এমনও নয়। তবে সম্পর্কটি সবসময়ই দৃঢ় গতিপথ বজায় রেখেছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো দুই দেশের মধ্যকার দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক, যা গত দুই দশকে আরও শক্তিশালী হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে চীন। 

মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের অর্ধেকের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২১৫৯.৪১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। মিউজ, লুয়েজ, চিনশেহ, কাম্পাইতি এবং অন্যান্য সীমান্তে অবস্থিত সীমান্ত পোস্টের মাধ্যমে মিয়ানমার চীনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য পরিচালনা করে। চীন, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত গ্রেটার মেকং সাব-রিজিয়ন ইকোনমিক কো-অপারেশন দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা জোরদার করার একটি বড় মঞ্চ।

মিয়ানমার ১৯৮৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত করার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে অনুমোদিত চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ মোট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরের (সিএমইসি) মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে আসছে। 

সিএমইসির অধীনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প,  যেমন-মি লিং গিয়াং এলএনজি টার্মিনাল, কিয়াউকফিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্র বন্দর, মিউজ-মান্দালয় রেললাইনকে সহজতর করে তোলার জন্য মান্দালয়-মিউজ রোডের সংস্কার মিয়ানমারে চীনা অর্থনৈতিক স্বার্থের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

মিয়ানমার সাধারণত চীনে চাল, মটরশুঁটি ও তিলের মতো কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে থাকে। ২০১৯ সালে চীনে মিয়ানমারের কৃষি রপ্তানির পরিমাণ ছিল তার মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়াও দেশটি চীনে জেড এবং তামার মতো বেশ কিছু খনিজ রপ্তানি করছে। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারে চীন থেকে প্রাথমিকভাবে যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স এবং টেক্সটাইলের মতো শিল্পোৎপাদিত সামগ্রী আমদানি করা হয়।

মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সম্পর্ক বিভিন্ন কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত অর্থনীতি অগ্রসর হওয়ায় মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি চীনের চাহিদা বেড়েছে। মিয়ানমার তেল, গ্যাস, কাঠ এবং খনিজ পদার্থের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং চীন এই খাতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। ২০২১ সালে মিয়ানমার থেকে ১২.৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের মুক্তা, মূল্যবান পাথর এবং ধাতু চীনে রপ্তানি করা হয়েছিল। 

দ্বিতীয়ত বিআরআই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরসহ (সিএমইসি) বিআরআই-এর অধীনে বেশ কয়েকটি পরিকাঠামো মিয়ানমার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিএমইসির মধ্যে রয়েছে কিয়াউকফিউ-এ গভীর সমুদ্র বন্দর, একটি শিল্প পার্ক, চীনের কুনমিং এবং মিয়ানমারের মান্দালয়ের মধ্যে একটি উচ্চ-গতির রেল সংযোগ। 

সংযোগ পথ ছাড়াও চীনা সংস্থাগুলো বর্তমানে একাধিক রিসোর্স শেয়ারিং লিঙ্কের বাস্তবায়ন করছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে কিয়াউকফিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে ১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়। তবে মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। 

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতার সমস্যা। কয়েক বছর ধরে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি চলছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বাণিজ্য ঘাটতি মিয়ানমারের জন্য উদ্বেগজনক ছিল। কারণ এটি দেশটিকে তার আমদানির জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। আর এটি মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক চাপের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো-মিয়ানমারের কর্মীরা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ধারণা-চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মানুষকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান না করে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি জীবিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এবং পরিবেশগত গুণমান মেনে চলার ক্ষেত্রে খারাপ পরিসংখ্যানের জন্য চীন বরাবরই সমালোচিত হয়েছে।

ঋণ ভীতির দিকটি আরেক উপাদান, যা অর্থনীতিবিদদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। অন্যান্য দেশে পরিলক্ষিত হওয়া চীনের উন্নয়ন মডেল প্রায়ই রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, যার জন্য ওয়ারেন্টি হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি জীবিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এবং পরিবেশগত গুণমান মেনে চলার ক্ষেত্রে খারাপ পরিসংখ্যানের জন্য চীন সমালোচিত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষক বারংবার দাবি করেছেন যে, চীনা ঋণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘গোপন’ থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা বিশ্ব ব্যাংকের মতো উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। কারণ মিয়ানমারের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে প্রশ্নাতীতভাবে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে গোপন রাখার জন্য মিয়ানমারের জনগণ ক্ষুব্ধ। চীনা নেতৃত্বাধীন ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ক্রমাগত আগ্রাসনের দিকেই পরিচালিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ২০২১-২০২২ সালের মধ্যে কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠানের উপর ভাঙচুরের কথা উল্লেখযোগ্য। 

এ কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ-মিয়ানমার চীনের বাণিজ্য আগ্রাসন সম্পর্কে অজ্ঞাত নয় এবং এই অঞ্চলে চীনা গতিবিধির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার পূর্ববর্তী অবস্থান যেমন মিতসোন বাঁধের মতো প্রকল্পের বিরুদ্ধে রায় দান করা, যথাযথ চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালানোর মতো সতর্কতা অবলম্বন করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, কিয়াউকফিউ প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে এবং প্রকল্পটিতে মিয়ানমারের অংশ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশটি জাপান ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গেও অংশীদারত্ব করেছে।

তবে বর্তমান জান্তা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিয়ানমারের জনগণের সশস্ত্র আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে, যা চীনের জন্য বড় চিন্তার কারণ। আবার বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই জান্তা সরকারের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন চীনের সমর্থন। যে কারণে চীনের একচেটিয়া বাণিজ্যের সব দাবিই তারা পূরণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //