রাশিয়া-ইউক্রেন শস্যচুক্তি বাতিল

হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপরই বিশ্ব অর্থনীতিতে যে চাপটা পড়তে থাকে, তা হলো- খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। পরে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া গত বছরের ২২ জুলাই শস্যচুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছিল। কয়েক দফা এ চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ১৭ জুলাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। রাশিয়া চুক্তি নবায়নের জন্য কয়েকটি শর্ত দিয়েছে। যা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা সরানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। কার্যত এসব শর্তে পশ্চিমাশক্তি কখনোই রাজি হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। তাই শস্যচুক্তিটিও এখন আর আলোচনার টেবিলে নেই। তবে এর প্রভাবে বাংলাদেশসহ ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানিকারক দেশগুলো যেমন ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়বে; তেমনি বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তাও পড়বে হুমকিতে। 

শস্যচুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেন কৃষ্ণসাগর ব্যবহার করে সারা বিশ্বে নিজেদের শস্য রপ্তানি করত। স্বাভাবিকের তুলনায়   এক-তৃতীয়াংশ কম হলেও গত এক বছরে তিন কোটি ৩০ লাখ টন শস্য রপ্তানি করেছে দেশটি। ইউক্রেন তার ৯০ শতাংশ শস্য রপ্তানি করে কৃষ্ণসাগর রুটে। প্রতিবেশী দেশ রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের উপর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনীয় শস্যের মাধ্যমে এই দুটি দেশের বাজার সয়লাব হয়ে সেখানকার স্থানীয় পণ্যের দাম কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা ইতোমধ্যে সেসব দেশের কৃষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করেছে। আরেকটি বিকল্প রুট দানিয়ুব নদীর মাধ্যমে মধ্য ইউরোপে শস্য রপ্তানি। এ পথে গত এক বছরে ২০ লাখ টন শস্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ছয় লাখ টন। এ দুটি বিকল্পই ইউক্রেনের জন্য সুখকর কিছু নয়। কারণ এগুলো বেশ ব্যয়বহুল।

রাশিয়া ও ইউক্রেন গম, বার্লি, ভুট্টা, সরিষা ও সরিষার তেল, সূর্যমুখী ফুল ও সূর্যমুখী ফুলের তেলের প্রধান দুটি উৎপাদক দেশ। এ ছাড়া নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস সারেরও প্রধান উৎপাদক তারা। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য ও সারের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্যের বাজারে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শস্যচুক্তিটি বাতিল হয়ে পড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের অবদানও কম নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় শস্যচুক্তিটি এমনিতেই ভঙ্গুর হতে শুরু করেছিল। গত বছর কয়েকবার চুক্তিটি স্থগিত হয়েছিল। এ বছরের মার্চ মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা রাশিয়ার কৃষির ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, শস্যচুক্তির মূল মাপকাঠিটাই এখন আর কার্যকর থাকছে না। 

এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া জাতিসংঘের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখে। প্রথমত রাশিয়ার কৃষি সম্পর্কিত ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটের সঙ্গে আবার যুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত শস্যচুক্তির আলোচনা শুরুর সময় থেকেই রাশিয়া ওডেসা বন্দর দিয়ে অ্যামোনিয়াভিত্তিক সার রপ্তানির দাবি জানিয়েছিল। তৃতীয়ত কৃষি খাতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে রাশিয়া। দেশটির জাহাজগুলো ইনস্যুরেন্স কিনতে পারছে না, বিদেশের অনেক বন্দরে তাদের প্রবেশাধিকারও নেই।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা হিসেবে রাশিয়া তাদের সার ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, লাইসেন্সের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং রপ্তানি কর বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছে রাশিয়া। পাশাপাশি রাশিয়া তাদের কৃষিপণ্য ভারতের মতো দেশে সরাসরি বিক্রি করতে চলেছে। গত ১৭ জুলাই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা দেন, ‘কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি আর কার্যকর নেই।’ মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে শস্যচুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরপরই বন্দরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো শুরু করে। যদিও এর আগে দেশটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বন্দরে হামলা চালানো হবে না। চুক্তি না থাকায়, বন্দরে হামলা না চালানোর কোনো বাধ্যবাধকতাও আর নেই। ধ্বংসকৃত স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী কোম্পানি কেরনেলের একটি শস্য টার্মিনাল। কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহে ৬০ হাজার টন শস্য ধ্বংস হয়েছে। কেরনেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়েভহেন ওসিমভ বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম দুই-তিন মাস আমরা রপ্তানি বন্ধ রেখেছিলাম। তেল ও শস্যের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। এখন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’ বৈশ্বিক শস্যের বাজার এখনো পর্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে বলে মনে হলেও রাশিয়া চুক্তি প্রত্যাহার করার এক দিনের মধ্যে শস্যের দাম আট শতাংশ বেড়ে যায়, যা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে একদিনে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।

২৭ ও ২৮ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় রাশিয়া-আফ্রিকা ইকোনমিক ও হিউম্যানিটারিয়ান ফোরামে নিশ্চিতভাবেই এটি মূল আলোচ্য বিষয় হবে। এ সম্মলনকে সামনে রেখে পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামপোসাকে ডেকে আফ্রিকা মহাদেশের খাদ্য ও সার রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া যেসব সমস্যায় পড়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন।

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম এক লাফে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। মূল্যস্ফীতি বা বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ প্রথমত খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মূলত আমিষের পরিমাণ কমে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুই লাখ থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার শিশুর গর্ভাবস্থায় পুষ্টি বঞ্চনা কিংবা পরবর্তী সময়ে অপুষ্টির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ১৭-২৪ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যখন দাম কমছে, ঠিক তখনই স্থানীয় বাজারগুলোয় বাড়ছে। এসব বাজারে বর্তমানে দাম অনেক উঁচুতে রয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে নিট খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোয় ঝুঁকি প্রকট হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেরিদ বেলহাজ বলেন, ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দ্বারা আক্রান্ত হবে তরুণ প্রজন্ম। দুঃখজনকভাবে যা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অক্ষমতা বা নিষ্ক্রিয়তার মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য অত্যধিক। এ অঞ্চলের জন্য সাহসী নীতির প্রয়োজন, কেননা এখানকার জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি তরুণ।’

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থাকবে। মূল্যস্ফীতিও থাকবে বাড়তি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, তীব্র খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের অন্তত ৫৩টি দেশের ২২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন হবে। ফলে বিশ্বের অনেক মানুষের রাতের বেলা ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যেতে হবে। 

প্রসঙ্গত মিশর ও ইন্দোনেশিয়ার পর ইউক্রেন থেকে গম আমদানির তৃতীয় বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করে প্রায় ১১ লাখ টন (১৫ শতাংশ)। বাকিটা আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে বছরে ২৩ লাখ টন আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশে গমসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য এবং এর সংশ্লিষ্ট পণ্য যেমন আটা-ময়দা, ভোজ্য তেল, পোল্ট্রি ও বেকারি পণ্যের দামও বাড়তে থাকে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিপ্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা।

তুরস্কের বিশ্লেষক মুরাদ আসলান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘বাংলাদেশের উচিত হবে গম বা ভুট্টা আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প দেশ খোঁজা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে উজবেকিস্তান, ইথিওপিয়া একটি ভালো উৎপাদক দেশ হতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সেই দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। যেন তারাও বাংলাদেশের চাহিদা অনুসারে তাদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি সহজ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। অথবা তুরস্কের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে এই খাদ্যশস্য বাংলাদেশ কিনতে পারে। যদি একটি দেশের মৌলিক খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হয়, তখন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ দেওয়ার কথা না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //