চ্যালেঞ্জের মুখে মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা

ক্রমবর্ধমান সুদের হার, অবিক্রীত বাণিজ্যিক আবাসন, বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়া এবং বর্ধিত নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও মাঝারি আকারের ব্যাংকগুলোকে চাপে ফেলেছে, যার ফলে একীভূতকরণের তরঙ্গ জোর পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ফলাফলে আরও চাপ বোধ করতে পারে। জিওনস ও কিকর্পসসহ আর্থিক মূল্যায়ন সংস্থাগুলো এবিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করেছে।

বিশ্লেষক ক্রিস ওল্ফের মতে, আগামী দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক ব্যাংক সম্ভবত প্রতিযোগীরা গ্রাস করে নেবে। ল্যাজার্ডের সিইও পিটার ওরসজাগ বলেন, এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ক্রেতা হয়েই টিকে থাকবে। আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অল্প কয়েকটি বড় আঞ্চলিক ব্যাংকের দেখা পাব। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় ১০ মার্চ ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ (এসভিবি) বন্ধ ঘোষণা করে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। ১২ মার্চ নিউইয়র্কভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বন্ধ ঘোষণার পর ব্যাংক দুটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। তখনই বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন যে, মার্কিন ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা অচিরেই কাটছে না।

এপ্রিলের শেষের দিকে ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে নেয় আর্থিক ঋণদাতা সংস্থা জেপি মর্গান। তারা ২২৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠানটির সিইও জেমি ডিমন কয়েক সপ্তাহের অস্থিরতার পর জানান, সংকটের এই অংশটি শেষ হয়েছে। জেপি মর্গানের শেয়ার এ বছর ৭.৬ শতাংশ বেড়েছে, অপরদিকে কেবিডব্লিউর মতো আঞ্চলিক ব্যাংকের শেয়ার ২০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।

একাধিক ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, একীভূত হতে এক বছর বা তার বেশি সময় লাগবে। চুক্তি বাস্তবায়ন ও অস্থিরতা কাটতে এ সময়টুকু লাগবে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন যখন ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য একটি উন্মুক্ত আহ্বান জানিয়েছেন, বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো তার প্রতি একরকম অনাস্থা ও উদ্বেগ জানিয়েছে। সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনসহ প্রভাবশালী আইন প্রণেতারা ব্যাংক একীকরণের বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, এর মধ্য দিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা একীভূত হয়ে উঠতে পারে।

অল্প পুঁজির ব্যাংকগুলোর জন্য যখন দুর্দশা কড়া নাড়ছে, তখন এটি অন্য ব্যাংকের জন্য সুযোগ। নিউইয়র্কভিত্তিক অ্যামালগামেটেড ব্যাংকের ৭.৮ বিলিয়ন সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সিএফও জেসন ডার্বির মতে, সামনে আরও বেশি সংখ্যক ব্যাংক তাদের হাত বাড়িয়ে বলবে, ‘আমরা কৌশলগত অংশীদার খুঁজছি।’

কেন্দ্রীয় ব্যংকের চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সুদহার বড় প্রভাব বিস্তার করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানো শুরু হয়। বর্তমানে এ হার বাড়ানো কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রয়েছে এবং সার্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজার এখন খুবই উত্তপ্ত। যা রিজার্ভ ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ফেডারেল রিজার্ভ হয়তো সুদহার আবারও বাড়াতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কাজ করতে হবে। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আর্থিক অবস্থার বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা থেকে অর্থনৈতিক সংযম কমানোর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

শেয়ারের দাম থেকে শুরু করে সরকার, ব্যবসা ও পরিবারের জন্য ঋণের খরচের পরিমাপ পর্যন্ত সবকিছু বিবেচনায় নেওয়া আর্থিক পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতি চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফেডারেল রিজার্ভের কাক্সিক্ষত স্বল্পমেয়াদি সুদহারের পরিবর্তনগুলো বৃহত্তর অর্থনীতিতে প্রয়োগ করার জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ হিসাব ব্যবস্থায় বর্তমান শিথিলতার অর্থ হলো বাজার ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক পৃথক পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

পাইপার স্যান্ডলারের গ্লোবাল পলিসির প্রধান বেনসন ডারহাম বলেছেন, ‘ঢিলেঢালা আর্থিক অবস্থা স্পষ্টতই নিকট-মেয়াদি প্রবৃদ্ধি বাড়ায় এবং অর্থনীতিতে ফেডারেল রিজার্ভ যে সংযম আরোপের চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।’

সম্প্রতি ফেডারেল রিজার্ভ প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, জুনে আর্থিক অবস্থা বেড়ে মে মাসের দশমিক ৬০৩ রিডিং থেকে দশমিক ৪৫৮-এ দাঁড়িয়েছে। তবে সূচকটি এখনো ২০২২ সালের আগস্টের পর থেকে সর্বনিম্নে। সূচকে আর্থিক পরিস্থিতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে বা বৃদ্ধিকে বাধা দিচ্ছে কিনা তা বর্ণনা করে। অন্যদিকে গোল্ডম্যান স্যাকসের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে আর্থিক অবস্থার সূচক মে মাস থেকে মোটামুটি ধীরগতিতে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানানো হয়। একই অবস্থা গত বছরের আগস্টের শেষের দিকেও দেখা গেছে। জুলাইয়ের শেষের দিকে শিকাগো ফেডারেলের সর্বশেষ সূচকটিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।

২০২২ সালের মার্চ থেকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি সুদহার বাড়ানোর আগ্রাসী প্রচারণায় নেমেছে। চলতি সপ্তাহে এক-চতুর্থাংশ শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধির পর ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তার লক্ষ্যমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি থেকে ৫.২৫ ও ৫.৫ শতাংশের মধ্যে নিয়ে গেছে। বন্ধকি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। একই সময়ে বেড়েছে অন্যান্য ঋণের খরচও। অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ডলারের দাম বাড়ায় অন্তত কিছু সময়ের জন্য সুদহার বৃদ্ধির ধাক্কা লেগেছে স্টক মার্কেটেও। কঠোর আর্থিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চাওয়া বাস্তবায়নে সহায়ক হয়েছে। বিশেষ করে কয়েক দশকের মধ্যে মূল্যস্ফীতি চড়া হওয়ার প্রবণতাকে দমাতে। কিন্তু ঘটনাগুলো এখন অন্যভাবে স্থানান্তর হচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে কড়াকড়ি আরোপের সময় শেষ হওয়ায় ফেডারেলের টার্গেট পূরণে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে এক মাস বিরতির পর ফের সুদহার বাড়িয়েছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ, যা ২২ বছরের সুদহার বৃদ্ধির পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ধীরগতি সত্ত্বেও ফেড সংকোচনমূলক আর্থিক অবস্থান গ্রহণ করছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে টানা দশমবারের মতো সুদহার বৃদ্ধির পর গত জুন মাসে ফেড আর্থিক কড়াকড়ি আরোপে খানিকটা বিরতি টানে। ব্যাংকের ঋণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নীতিনির্ধারকদের মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা মূল্যায়নে সময় দেওয়ার জন্য ফেড এক মাসের এ বিরতি নিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির মধ্যেই এ সম্ভাবনাও শক্তিশালী হয়েছে যে ফেডের রেট-সেটিং ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি (এফওএমসি) সুদহার এক-চতুর্থাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধির পক্ষে ভোট দিতে পারে। যা ফেডারেল তহবিলের হার ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে বাড়বে। ফলে সুদহার বৃদ্ধির পরিমাণ ২০০১ সালের পর সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছবে।

ব্যাংক অব আমেরিকা করপোরেশনের প্রধান মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল গ্যাপেন এক নোটে বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস ধীরগতিতে ঘটছে। আমরা মনে করি, কমিটির বেশির ভাগ সদস্য বিশ্বাস করেন, মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস অব্যাহত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে আরও ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন।’ সিএমই গ্রুপের মতে, ফিউচার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অবশ্য সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায় ৯৯ ভাগ সম্ভাবনার কথা বলছেন। গত মাসের সভায় ফেডের কর্মকর্তারা অবশ্য এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তারা মনে করছেন, চলতি বছরের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে সামলানোর জন্য সুদহার এক-চতুর্থাংশ পয়েন্ট বাড়ানো হতে পারে। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৬ মাস ধরে ফেডারেল রিজার্ভের যে প্রচেষ্টা, তার ফল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। প্রভাব পড়েছে সুদহার বৃদ্ধির। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে অপ্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। এপ্রিল-জুন সময়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২.৪ শতাংশে, যা সর্বশেষ আইএমএফের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হয়েছে, দেশটির জিডিপি জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সর্বশেষ প্রান্তিকে অর্থনীতি সম্প্রসারণের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল ১.৫ শতাংশ। গত প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধি প্রভাবিত হয়েছে মূলত বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে। আবাসন খাত বাদ দিলে ব্যবসায় ব্যয় বেড়েছে বার্ষিক ৭.৭ শতাংশ। ২০২২ সালের প্রথম দিকের পর এটাই সবচেয়ে দ্রুতগতির বৃদ্ধি। কোম্পানিগুলো উৎপাদনের পেছনে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার ব্যয় বাড়িয়েছে, যা এপ্রিল ও জুনে অর্থনীতিকে বিস্তৃত হতে সহযোগিতা করেছে। ফেডারেল রিজার্ভের প্রচেষ্টা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //