ব্রিকসের সম্প্রসারণ

ডলারের আধিপত্য কি হুমকির মুখে

মার্কিন ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মুদ্রা। তবে তার আধিপত্য সম্প্রতি হুমকির মুখে পড়েছে। এবছরের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে চীন-রাশিয়া নেতৃত্বাধীন পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সদস্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা প্রশ্ন তোলেন, কেন সব দেশ ডলারে লেনদেন করবে। এরপর রাশিয়ার এক শীর্ষ কর্মকর্তা ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা চালু হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রিকসের সেই মুদ্রা আলোর মুখ না দেখলেও ডলারের আধিপত্য আগের মতো থাকছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বে ডলার হলো প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা। বলা হয়, বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ ডলারে লেনদেন হয়। ডলারের এই আধিপত্য কমানোর চেষ্টা নতুন নয়। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণ এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের উত্তেজনা বেড়েছে। এই পরিস্থিতি ব্রিকসকে ডলারের আধিপত্য নিয়ে ভাবাচ্ছে; বিশেষত চীন ও রাশিয়ার ওপর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর তা আরও প্রকট হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো শিরলে জে উ বলেন, ‘রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রিজার্ভের জন্য ডলারের বিকল্প খুঁজছে। এমনকি লেনদেনে সুইফটের বিকল্প আন্তর্জাতিক মাধ্যম খোঁজা হচ্ছে।’ গত ৪০ বছরে চীনের ব্যাপক উত্থান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফল ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমা নিয়ে সম্প্রতি যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো, তাতে মার্কিন ডলারের আধিপত্য নতুন করে নজরদারিতে এসেছে। এ বাস্তবতায় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ভিটিবির প্রধান নির্বাহী আঁদ্রেই কোস্তিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মার্কিন ডলারের আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে আসছে। কারণ হিসেবে তিনি চীনা মুদ্রা ইউয়ানের উত্থান ও রাশিয়াকে বাগে আনার পশ্চিমা ব্যর্থ চেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববাসী পশ্চিমের এই ব্যর্থ চেষ্টার ঝুঁকির মুখেও পড়ে গেছে। অনেক দেশ এখন ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য মুদ্রায় বাণিজ্য করছে এবং চীনা মুদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞার নীতি থেকে সরে আসছে। রাশিয়া এখন তৃতীয় দেশের সঙ্গেও চীনা মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে আলোচনা করছে।’

এদিকে বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ডিডলারাইজেশন বা ডলারের আধিপত্য খর্ব হতে শুরু করেছে। রিজার্ভে ডলারের অংশীদারত্ব কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ইউরো ও চীনা মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ হিসেবে স্বর্ণ কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত আইএমএফের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের রিপোর্টেড রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অনুপাত কমছে। ১৯৯৯ সালে সারা বিশ্বের ৭০ শতাংশের বেশি রিজার্ভ ছিল মার্কিন ডলারে, ২০২১ সালে যা নেমে এসেছে ৫৯ শতাংশে। ২১ শতাংশের মতো বৈশ্বিক রিজার্ভ রয়েছে ইউরোতে। ডলারের প্রতিস্থাপনের জায়গায় অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল রিজার্ভ মুদ্রা যেমন ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড ইত্যাদির হার বাড়ছে না। দেশগুলো রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনতে বাড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, চীনা রেনমিনবি ইত্যাদি মুদ্রার মজুদ। ডলারের এ প্রতিস্থাপনের এক-চতুর্থাংশ মাত্র হয়েছে রেনমিনবিতে, বাকিটুকু অন্য কয়েকটি মুদ্রায়। ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে সারা বিশ্বের রিজার্ভের ৫৮.৩ শতাংশ ছিল মার্কিন ডলারে, ২.৭ শতাংশ ছিল রেনমিনবিতে। জাপানিজ ইয়েন কিংবা ব্রিটিশ পাউন্ডের বৈশ্বিক রিজার্ভ ৫ শতাংশের আশপাশে থাকে।

ব্রিকসের বর্তমান সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। গত ২২ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনের শেষ দিন ২৪ আগস্ট ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। আমন্ত্রণ পাওয়া দেশ ছয়টি হলো-----আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্রিকসে দেশ ছয়টির সদস্যপদ ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। জোটের সম্প্রসারণসহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের বিকল্প হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (ব্রিকস ব্যাংক) এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ পশ্চিমের কিছু লোকের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব দিয়েই ডলার দুনিয়ার প্রধান মুদ্রা হয়ে ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, সবচেয়ে বড় ক্রেতা, তারা বিশাল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি বজায় রাখে, তাদের আর্থিক বাজার অত্যন্ত খোলামেলা এবং সেখানে আইনের শাসনে বিনিয়োগের নিরাপত্তা আছে- এসব বিষয় ডলারকে রিজার্ভ, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রায় পরিণত করেছে গত সাত দশকে।

এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্রিকস বা অন্য কোনো মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের কিংবা ঋণের মূল্য পরিশোধ তাদের মুদ্রায় সম্পন্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়। তাকে প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হতে হলে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোতে বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে- মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিতে হবে; বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং সুদহার ও মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা; বাণিজ্য উদ্বৃত্তের সুবিধা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে, চলতি হিসাব ঘাটতির দিকে যেতে হবে। বৈশ্বিক চাহিদার অসাম্যের একাংশও নিজেদের কাঁধে নিতে হবে ব্রিকসকে, যা যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজরির বিনিয়োগ বিশ্লেষক ক্রিস ওয়েফার বলেন, ‘ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর সরকারও জানে, স্বতন্ত্র মুদ্রা চালু করা কার্যত অসম্ভব। দীর্ঘ সময় পরও এটা কার্যকর হবে না। ব্রিকসের অভিন্ন মুদ্রা চালুর ধারণাই অবাস্তব। কেননা আধিপত্যের শিকার হওয়ার ভয়ে চীনের সঙ্গে অন্য দেশগুলো তাদের আর্থিক নীতি মেলাতে চাইবে না। তাই ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্রিকসের দেশগুলো বড় পরিসরে নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন শুরু করতে পারে। চীন-রাশিয়ার মধ্যে ৮০ শতাংশ বাণিজ্য রুশ বা চীনা মুদ্রায় হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অন্য দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ব্রিকস মুদ্রা চালুর চেয়ে এটা হবে কার্যকর কৌশল।’

সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে ডলারকে ছাপিয়ে একক কোনো মুদ্রার দ্রুত প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। তবে তার মানে এই নয় যে ডলারের আধিপত্যের রূপ আগের মতোই থাকবে। চীন-রাশিয়ার যৌথতা ও নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মুদ্রানীতি ইত্যাদিকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। সে পরিবর্তনের গতিপথে ডলারের আধিপত্য হয়তো আগামী কয়েক বছরে আরও খর্ব হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //