চীনের সিল্ক রুটের বিপরীতে পশ্চিমা ‘স্পাইস রুট’

এবার জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে যৌথ ঘোষণা এসেছে। এর আগের বালি সম্মেলনের মতো এবারও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শক্তিশালী রুশবিরোধী অবস্থান নিতে পারেনি জি-২০। তবে এবারের সম্মেলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সংযোগ করিডর চালুর সিদ্ধান্ত। মধ্যযুগে যে পথে ভারত থেকে ইউরোপে মসলা নেওয়া হতো, সে পথটি আবার চাঙ্গা করা হচ্ছে। এ মসলার পথ বা ‘স্পাইস রুট’কে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বা সিল্ক রুটের পাল্টা প্রকল্প বলে মনে করা হচ্ছে। 

দিল্লি ঘোষণাপত্রে যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হলে- এক. শক্তিশালী, টেকসই, ভারমাস্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধি। দুই. এসডিজিতে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা। তিন. একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সবুজ উন্নয়ন চুক্তি। চার. ২১ শতকের জন্য বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান। পাঁচ. বহুপক্ষীয়তাকে পুনরুজ্জীবিত করা। বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, জি-২০ জোটের শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষ ‘স্পাইস রুট’ গঠনের চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। চীন সিল্ক রুট প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। এর বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে ‘স্পাইস রুট’কে। তথ্য, রেল, বিদ্যুৎ ও হাইড্রোজেন পাইপলাইনের মতো প্রকল্প থাকছে মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ সংযোগ করিডর চালুর এই পরিকল্পনায়।

প্রস্তাবিত এক প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রেল ও বন্দরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেসব দেশের রেল-বন্দর এই যোগাযোগের আওতায় আসতে পারে, তারা হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, জর্দান ও ইসরায়েল। এর ফলে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যের গতি বর্তমানের তুলনায় ৪০ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। তবে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক এখন খুব ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক চুক্তি ও ২০১৮ সালে ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে তা রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো হতে সাহায্য করতে পারে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের প্রধান কারণ- দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমানো। চলতি বছরের মে মাসে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যথাক্রমে অজিত দোভাল ও জ্যাক সুলিভানের বৈঠকে এই প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। তারপর কথাবার্তা এগোয় দ্রুতগতিতে। বিতর্কিত আকসাই চীন ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তানের মধ্য দিয়ে ‘বিআরআই’ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলে। ভারতের আপত্তি তারা আমলেই আনছে না। এই পরিস্থিতিতে পাল্টা এমন কিছু একটা করতে তিনি আগ্রহী ও উৎসাহী হয়েছেন স্বাভাবিক কারণেই।

যুক্তরাষ্ট্রের উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ফিনার বলেন, এই রুট তৈরির উদ্যোগের ‘অমিত সম্ভাবনা’ রয়েছে। মাসের পর মাস ধরে সতর্ক কূটনৈতিক তৎপরতা, নীরব ও সাবধানী কূটনীতি, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার পর এ বিষয়ে জনসমক্ষে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট দুই করিডর মিলে এই প্রকল্প চূড়ান্ত হবে। একটি ‘ইস্ট-ওয়েস্ট’, যা ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার সংযোগকারী। অন্যটি ‘নর্দান করিডর’, যা পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র হবে ইউরোপের সঙ্গে।

তবে এই বিরাট প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে হবে, জি-২০-তে যোগদানকারী এই দেশগুলোর কোনো নেতাই তা স্পষ্ট করেননি। প্রকল্প শেষের সময়সীমাও নির্ধারণ করা হয়নি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এখনো অনেক জটিলতা কাটানো বাকি। মূলত নীতিগত ঘোষণাই শুধু দেওয়া হয়েছে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে।

প্রসঙ্গত এই পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার আগে এএফপি জানিয়েছিল, ইইউ নেতাদের কাছে ‘ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর কোনো অংশে কম ঐতিহাসিক নয়।’ এই চুক্তি বাণিজ্য বাড়াবে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ সংযোগ করিডর সংযোগ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়নের দিশা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে এই করিডরটি ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অর্থনৈতিক জোটের জন্য একটি কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠবে।’ ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ সংযোগ করিডরের প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। তিনি বলেন, ‘এটা সত্যিই একটা বড় চুক্তি। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ইউসুলা ভন ডের লিয়েনও এই করিডর স্থাপনকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেছেন।

প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। অংশগ্রহণকারীরা এখনো পরীক্ষা করে দেখছেন যে ভারতের ১৪০ কোটি মানুষ ও দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতিকে কীভাবে পশ্চিমের বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এ অর্থনৈতিক করিডর এমন অবকাঠামো গড়ে তুলবে যাতে করে ‘পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন’ উৎপাদন ও পরিবহন করা যায়। এছাড়া সাগর তলে নতুন কেবল (তার) স্থাপন করে টেলিযোগাযোগ ও ডেটা সঞ্চালন আরও জোরদার করাও এই উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘যদি এটা (ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর) চূড়ান্ত হয়, তাহলে তা ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যোগাযোগ শক্তিশালী করবে এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের পাল্টা হিসেবে কাজ করবে।’ বিআরআইকে প্রায়শই নতুন সিল্ক রোড হিসেবে বর্ণনা করা হয়, এর মাধ্যমে চীন তার প্রভাব, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ইতোমধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নিয়ে গেছে।

চীন এখনো এই প্রকল্প নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অংশীদার বাংলাদেশ এই প্রকল্পে যুক্ত নয়। বরং চীনের ‘বিআরআই’ প্রকল্পের সঙ্গী বাংলাদেশ। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কও সুদৃঢ়। চীন-ভারত সম্পর্কের গতিপথই এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //