অটোমান শাসন ও গ্রিকদের মিথ্যাচারের ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম আনাতোলিয়ার গ্রিস দখলের বিষয়টি বর্তমান যুগেও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা জনসাধারণের মধ্যে গ্রিস ও মিত্রপক্ষ সে সময়ের ঘটনাকে এমনভাবে চিত্রিত করেছে যেন বিপর্যয়কর এই ঘটনার জন্য তুরস্ক দায়ী।

আর এ ধারাবাহিকতায় তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর পার্লামেন্টসহ যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটকে চাপ দিয়ে আসছে যে গ্রিকদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছ তুরস্ক- এমন অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। একই সঙ্গে এ অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের খুঁজে বের করে তাদেরকে যেন আইনের আওতায় আনা হয় এমন দাবিও জানিয়ে আসছে গ্রিস। 

১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ইজমির থেকে আঙ্কারা, এডিরনে থেকে মুগলা এবং আনাতোললিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত দখলসহ নানা বিষয়ের সবকিছু ঐতিহাসিক প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আর সেসময় গ্রিস এবং গ্রিক লবির আচরণ বিধিমালাও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। অন্যদিকে গ্রিক লবিস্টদের জন্য তথাকথিত ‘পন্টিক বা গ্রিক গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত ঘটনাগুলো ‘ইউরোপ থেকে তুর্কিদের বিতাড়নের’ একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। যা বর্তমানেও পরোক্ষভাবে অব্যাহত রয়েছে বলে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। 

অটোমান সাম্রাজ্যে গ্রিকদের অবস্থা

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় অমুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। তখন তারা পুরো অটোমান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাণিজ্য, কূটনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে বিশেষ সুবিধাজনক জায়গাগুলোতে তাদের অবস্থান পোক্ত করে। গ্রিক বণিকরা প্রায় সব বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার পাশাপাশি অটোমান বন্দর এবং প্রধান ইউরোপীয় বন্দরগুলোয় পরিচালনার দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন। 

অটোমান সাম্রাজ্য অর্থোডক্স গির্জায় সার্বিয়ান, বুলগেরিয়ান ও রোমানিয়ানসহ গ্রিক পুরোহিতদের যাজক এবং প্রচারক নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করে। বিদ্রোহের যুগ পর্যন্ত এসব গির্জায় ধর্মীয় পরিষেবাগুলোর বিষয়বস্তুও গ্রিক ভাষায় সম্পাদিত হতো। ফলে গ্রিক পুরোহিতদের অন্যসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি অভিজাত গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। প্রায় এক শতাব্দী ধরে (প্রায় ১৭২০-১৮২০) ইস্তাম্বুলের ফেনার গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রশাসকদের ওয়ালাচিয়া ও মলদাভিয়ার (বর্তমান রোমানিয়া) রাজত্ব পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। ফলে উসমানীয় শাসনের অধীনে রোমানিয়ায় একটি গ্রিক এলিট শ্রেণি গড়ে ওঠে।

রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রিকদের পুনঃ আবিষ্কার

ইউরোপে আলোকিত যুগে গ্রিক সাহিত্য এবং প্রাচীন গ্রিক গণতন্ত্রের ধারণা উদার ও জাতীয়তাবাদী কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেসময় ব্যাপক বিশ্বাস ছিল যে গ্রিকরা যারা কিনা একসময় মহান সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা তুর্কি শাসনের অধীনে তাদের এই আশ্রয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না। তাই চাওয়া ছিল এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান। 

বলকান অঞ্চল দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করা এবং ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া, অটোমান অঞ্চলে বিশেষত মোরিয়া (পেলোপনিস) উপদ্বীপে বসবাসকারী গ্রিকদের প্রতি আগ্রহের প্রকাশ ঘটে। সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। উদার জাতীয়তাবাদের সমর্থকরা গ্রিকদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো শুরু করেন। পশ্চিম ও উত্তর থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়ায় গ্রিকরা ফিলিকি ইটেরিয়া সোসাইটি ব্যবহার করে একটি গোপন দলও গঠন করে। পরে ১৮১৪ সালে ইউক্রেনের ওডেসাতে রাশিয়ার জার উপদেষ্টা আলেকজান্ডার ইপসিলান্টিসের সমর্থনে অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হতে একটি উপায় খুঁজে বের করে তারা। এ ধারাবাহিকতায় অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮১৭ সালে। যা ১৮২১ সালে মোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ ১৮২৮-২৯ পর্যন্ত অটোমান-রাশিয়া যুদ্ধের পর এডির্নের চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে স্বাধীন গ্রিসের প্রতিষ্ঠা হয়।

জানা যায়, গ্রিক বিদ্রোহের সময়কালে ইউরোপের সব গির্জা এটিকে ক্রুসেডের সঙ্গে তুলনা করেছিল। ইংরেজ লেখক লর্ড বায়রন গ্রিসের জনগণ এবং তাদের কারণের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন আর সে কারণেই তাদের সমর্থনে মোরিয়াতে আসেন বায়রন। ১৮২৭ সালের নাভারিনোর যুদ্ধে অটোমান নৌবহরকে ধ্বংস করে দেয় তারা। গ্রিক কমিটি গঠনের প্রাথমিক দর্শন ছিল সহিংসতা অবলম্বন করা, গণহত্যার মিথ্যা প্রতিবেদন ছড়ানো, জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা এবং ইউরোপীয় কেন্দ্রে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। 

পেলোপোনিজদের ডি-তুর্কিফাই করার প্রচেষ্টা

এই সময়কালে মোরিয়া, নাভারিনো, ত্রিপোলি ও এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অঞ্চলে বসবাসকারী তুর্কিদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য গণহত্যা চালানো হয়েছিল, যার ফলে এই অঞ্চলগুলো থেকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। ১৮২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ত্রিপোলিৎসা (ত্রিপোলি) শহর গ্রিক বিদ্রোহীদের দখলে আসার পর একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। তার শিকার হয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশি মুসলমান। সে গণহত্যায় ইহুদিরাও প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার অ্যালিসন ফিলিপস তার ‘দ্য ওয়ার অব গ্রিক ইনডিপেনডেন্স’ (১৮২১-১৮৩৩) গ্রন্থে লেখেন যে কীভাবে তিন দিন ধরে শহরের বাসিন্দাদের বয়স বা লিঙ্গ বিবেচনা না করে একটি বর্বর জনতা হত্যাযজ্ঞের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। 

আরেকটি সবচেয়ে দুঃখজনক দিক ছিল, ইউরোপীয় জনমত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কূটনৈতিক কেন্দ্র এবং সরকার এ গণহত্যা সম্পর্কে নীরবতা পালন করে, যা ১৯২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আবার কেউ কেউ বলে, তুরস্ক এটির প্রাপ্য ছিল। ১৯১২-১৯১৩ সালে বলকান যুদ্ধের সময় এই গণহত্যার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছিল। সেসময় তারা বলকান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে মুসলমানরা গ্রিক, সার্ব ও বুলগেরিয়ানদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এই ঘটনার পেছনে মাস্টারমাইন্ডের ভূমিকায় ছিল রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ইতিহাসবিদ জাস্টিন ম্যাকার্থি তার রচনা ডেথ অ্যান্ড এক্সাইলে লেখেন, ১৮২১-১৯২২ সালের মধ্যে বলকান অঞ্চলে ৫০ লাখেরও বেশি তুর্কি তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। আর ৫০ লাখেরও বেশি তুর্কি যুদ্ধ ও অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। 

মেগালি যুদ্ধ

এই প্রক্রিয়া চলাকালে অটোমান সাম্রাজ্যের সংকট ও প্রতিটি হেরে যাওয়া যুদ্ধকে গ্রিস সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করে। বলকান যুদ্ধের পর গ্রিস দক্ষিণ এপিরাস এবং থেসালোনিকিসহ এজিয়ান দ্বীপ ও মেসিডোনিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশে জয়লাভ করে। একই সঙ্গে ক্রিট দ্বীপকেও সংযুক্ত করে গ্রিস। আর এ সময়ে ভেনিজেলোস নামে এক নতুন গ্রিক জাতীয় নায়কের আবির্ভাব হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় গ্রিসের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা কনস্টেনটাইন আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভেনিজেলোস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রিসের প্রবেশের প্রধান কারণ ছিল পশ্চিম আনাতোলিয়ার নতুন অঞ্চল দখল। যা মেগালি ধারণার (বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার ধারণা) ঐতিহাসিক আদর্শবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভেনিজেলোস প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন ও কনস্টানটাইনের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। পরে থেসালোনিকিতে তিনি একটি আলাদা সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্রশাসনের সমর্থনে তিনি মেসিডোনিয়ান ফ্রন্টে বুলগেরিয়ান এবং তুর্কি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও লিপ্ত হন। 

অবশেষে ১৯১৭ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স গ্রিস দখল করে রাজা কনস্টেনটাইনকে ক্ষমতাচ্যুত এবং তার ছোট ছেলে আলেকজান্ডারকে সিংহাসনে বসিয়ে ভেনিজেলোসকে দেশের নেতা নিযুক্ত করে। আর গ্রিসকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //