ব্র্যান্ডের নাম ভাঙিয়ে মানবপাচার
বিদেশে ভালো চাকরির আশায় যখন দেশ ছাড়েন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহীন, তখন কল্পনাও করেননি প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভানুয়াতু দ্বীপে তাকে এভাবে বন্দি থাকতে হবে, বেতন ছাড়াই কাজ করতে হবে, অভিযোগ করলে শিকার হতে হবে মারধরের এবং কেবল পালিয়ে যেতে পারলেই মিলবে নিস্তার। ভানুয়াতু একটি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। যা ছোট-বড় প্রায় ৮০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এটি ১৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রতিশ্রুতি ছিল জীবন বদলে দেওয়ার, মিলিয়নিয়র পোশাক ব্যবসায়ীর হয়ে কাজ করার। অথচ একসময় তা রূপ নেয় আধুনিক দাসত্বে, যেখানে প্রতিনিয়তই মারধর ও হত্যার হুমকি পেতেন শাহীন।
ভানুয়াতু দ্বীপের দিনগুলো স্মরণ করতে গিয়ে শাহীন মন্তব্য করেন, সেখানে নিজেকে তার ‘জীবন্ত লাশ’ বলে মনে হতো। তিনি বলেন, আমার সব স্বপ্ন, সব প্রত্যাশা ধুলোয় মিশে গেছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালের মধ্যে ভানুয়াতুতে আসা ১০৭ বাংলাদেশির মধ্যে শাহীন একজন। নিজেকে পোশাকের আন্তর্জাতিক একটি চেইনশপের মালিক পরিচয় দেওয়া মানব পাচারকারী শিকদার সুমন তাদের এখানে নিয়ে আসে।
এই ১০৭ বাংলাদেশির পরিণতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে আধুনিক দাসত্বের সবেচয়ে বড় ঘটনা। শাহীন এবং তার সহকর্মীদের প্রতারণা ও মারধরের শিকারের ঘটনা সামনে আসার পাঁচ বছর পার হলেও কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, উন্নত জীবনের আশায় এখনো অনেকের প্রত্যাশিত গন্তব্য ভানুয়াতুর মতো দ্বীপ।
শাহীনের জীবনে এই দুর্যোগের শুরু ২০১৮ সালের জুনে। ওই সময় টাঙ্গাইলের একটি বাস স্টেশনে শিকদার সুমনের এক সহযোগীর সঙ্গে তার দেখা হয়। শাহীনকে বলা হয়, সুমন ‘মাল্টিমিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী’, বিশ্বব্যাপী তার পোশাক ব্যবসা রয়েছে।
শাহীন খোঁজখবর নেন। সুমনের দাবি সে দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড মি. প্রাইসের হয়ে কাজ করে। শাহীন ভানুয়াতুর স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন আগেই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখতে পান, যার শিরোনাম ‘ভানুয়াতুতে আসছে মি. প্রাইস’। সেখানে সুমন এবং ভানুয়াতুর একজন মন্ত্রীর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো শাহীনের মনে ইতিবাচক ধারণা আনে।
দেশে শাহীনের ছোট তবে সফল পোশাক ব্যবসা ছিল। এই ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে সেগুলো সুমন এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেন শাহীন। স্ত্রী-সন্তানকে বিদায় জানিয়ে মি. প্রাইসের হয়ে কাজ করতে ভানুয়াতুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়েন শাহীন। সে ঘটনার পাঁচ বছর হতে চলেছে, শাহীন এখনো দেশে ফেরেননি।
ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলায় আসার পর শাহীনের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। সমুদ্রতীরবর্তী একটি বাংলোতে তাকে আটকে রাখা হয়। ভাত আর বাঁধাকপি খেয়ে বেশিরভাগ দিন কাটিয়েছেন তিনি। সেখানে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদের দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করানো হতো।
২০২২ সালে এসে ভানুয়াতুর পাবলিস প্রসিকিউটর সুমন, তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে মানবপাচার, দাসত্ব, অর্থ পাচার, হত্যার হুমকি ও দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন।
শাহীন আল জাজিরাকে জানান, এসব হুমকিকে তারা কখনো হালকাভাবে নেননি। তিনি জানান, ভানুয়াতুতে আসার পরপরই সুমনের হয়ে কাজ করা এক বাংলাদেশি তাকে ঘুষি মারে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বলপ্রয়োগ করে তার থেকে ১৪ হাজার ডলার নিয়ে যায়।
আর টাকা দিতে না পারায় বলা হয়, তার উল্টো ঝুলন্ত, রক্তাক্ত ছবি বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছে পাঠানো হবে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ভীত অবস্থায় একদিন দিনের কাজের বিরতির মধ্যে যখন সুমনের লোকজন ঘুমাচ্ছিল তখন সুযোগ পেয়ে শাহীন ও আরও দুইজন বাংলো থেকে পালিয়ে যান। তারা সৈকতের দিকে ছোটেন এবং উপকূল ধরে এগুতে থাকেন। পাশে রাস্তায় তারা একটি গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়েন এবং তাদেরকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে বলেন।
পাচারকারীদের টার্গেট বাংলাদেশি
কর্তৃপক্ষের মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে শাহীনসহ বাকি বাংলাদেশিদের ভানুয়াতুতে নিয়ে যায় সুমন। অনেককে বলা হয়, সুমনের মি. প্রাইসে কাজ করতে তারা বৈধ পথে অস্ট্রেলিয়া, কিউবা কিংবা নিউ ক্যালেডোনিয়াতে যাচ্ছেন।
এরপর ভুক্তভোগীরা হয়ে যান সুমনের দাস। মারধরের হুমকির মুখে খুব সামান্য অর্থ অথবা বিনা পারিশ্রমিকে তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো হতো। স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে, ভানুয়াতুতে আসার পর তাদের দিয়ে জোর করে নির্মাণকাজ, কাঠের আসবাব তৈরি ও বিক্রি করানো হতো। কাজ করতে অস্বীকার করলেই মারধর চলতো। প্রতিশ্রুত চাকরি কিংবা বেতন কখনোই দেওয়া হয়নি তাদের।
তদন্তে উঠে আসে, ভানুয়াতুতে প্রকৃত ব্যবসা পরিচালনার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না সুমনের। মূলত শাহীনের মতো লোকদের থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় রেখে যাওয়াই ছিল সুমনের লক্ষ্য।
শহরের কেন্দ্রে মি. প্রাইস-এর একটি দায়সারা গোছের শোরুম তৈরি করেছিল সুমন। তদন্তকারীরা পরে জানতে পারেন, সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিটির ব্র্যান্ড আর লোগো বিনা অনুমতিতেই ব্যবহার করছিল।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর সুমন নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে দাবি করে, সে জিম্বাবুয়ের নাগরিক। যদিও তদন্তকারীরা পরে আবিষ্কার করেন, তার পাসপোর্ট আদতে জাল।
বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ। এসব অভিবাসীদের অনেকেই দালালদের ওপর নির্ভর করেন। এ দালালেরা বিদেশে সম্ভাব্য কর্মী এবং নিয়োগকারীদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশিকে বিদেশে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে এসব দালাল। এ দালালদের অনেকে অতীতে নিজেরাই পাচারের শিকার হয়েছিল।
বাংলাদেশের পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর ২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাপী পাচারের সবচেয়ে বেশি শিকার বাংলাদেশিরা।’
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান আবদুসাত্তার এসোয়েভ বলেন, পাচারের শিকার অনেককে বিদেশে পাড়ি দিয়ে তাদের এবং তাদের সন্তানদের জীবনকে নিরাপদ করার টোপ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, অনেকে তাদের সম্পদ এবং সারাজীবনের সঞ্চয় ব্যয় করে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে। এদের অনেকেই পাচারের শিকার হন। তাদেরকে জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নিগ্রহ বা ঋণের বোঝায় ঠেলে দেওয়া হয়।
ভানুয়াতুর ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান চার্লি উইলি রেক্সোনা বলেন, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে আসা বিদেশি কর্মীরা প্রায়ই তাকে বলেন যে তাদের পাসপোর্ট তাদের বসেরা আটকে রেখেছে। এটি মানব পাচারের একটি স্পষ্ট লক্ষণ। এখানে এখনো চোরাচালান চলছে। কিন্তু তা প্রকাশ পাচ্ছে না।
উইলি রেক্সোনা বলেন, সুমন তার স্ক্যামটি আরও কয়েকটি দেশে চালু করার চেষ্টা করেছিল। কয়েকটি দেশে তারা এটি পরীক্ষা করেছিল। এরপর তারা ভানুয়াতুর আইনে ‘ছিদ্র’ খুঁজে পাওয়ার পর এখানে ব্যবসা ফাঁদার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের এখানকার লোকজন মানবপাচারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেন না, এমনকি অভিবাসন কর্মকর্তাদের মধ্যেও স্পষ্ট ধারণা নেই।
আইনি প্রক্রিয়া অস্পষ্ট
অপরাধের স্বতন্ত্র প্রকৃতি এবং সুমনের ভুক্তভোগীর সংখ্যা পোর্ট ভিলায় দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর বিচারপ্রক্রিয়ার সময় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। ওই ১০৭ ভুক্তভোগী মামলার মূল সাক্ষী। কিন্তু ভানুয়াতু সরকারের কাছে তাদেরকে খাওয়ানো এবং রাখার ব্যবস্থা ছিল না।
ভানুয়াতুতে দাসপ্রথা এবং পাচারকে সংজ্ঞায়িত করে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তাই ভানুয়াতুর পাবলিক প্রসিকিউটর জোসিয়া নাইগুলেভু চার আসামির বিরুদ্ধে তার অভিযোগ গঠনে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশনের ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সুমন এখন ভানুয়াতুর কারাগারে ১৪ বছরের সাজা ভোগ করছে। তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে এর অর্ধেক বছর সাজা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বছরের শুরুতে তাদেরকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জরিমানা দেওয়ার পরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভানুয়াতুর ডিপার্টমেন্ট অভ কারেকশনস-এর পরিচালক জনি মারাঙ্গো সেই সময় স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে বিদেশি বন্দিদের স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়া ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা।
১০৭ ক্ষতিগ্রস্তকে মোট এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে চার অপরাধীকে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত, তবে ওই অর্থ এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে লঘু সাজা হয়েছে বলে নাইগুলেভু মনে করেন। নাইগুলেভু আল জাজিরাকে বলেন, 'সর্বোচ্চ সাজার ক্ষেত্রে আমাদেরকে এ দেশের আইন পর্যালোচনা করতে হবে।'
বিচারের পর থেকে শাহীন ছাড়া ভুক্তভোগীদের সবাই বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। শাহীন যেহেতু এ মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন, তাই তার আশঙ্কা বাংলাদেশে ফিরে আসার সাহস করলে সুমন এবং তার সহযোগীরা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। তাই ভানুয়াতুতে থাকা নিরাপদ মনে করে শাহীন তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছেন।
শাহীন আল জাজিরাকে বলেন, আমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করি কারণ আমি শুধু আমার বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।
শাহীনের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। ভানুয়াতুতে তার অভিবাসন মর্যাদা এখনো অচলাবস্থায় পড়ে রয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের মাধ্যমে শরণার্থী মর্যাদা অর্জনের জন্য তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। তবে তিনি এখনো আশা করেন, একদিন তিনি পরিবারকে আরেকটু উন্নত জীবন দিতে পারবেন। -আল জাজিরা
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : মানবপাচার প্রশান্ত মহাসাগর বাংলাদেশি অভিবাসী
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh