১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভের আগেই ইহুদি শরণার্থীরা দলে দলে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে।
বলা হয়ে থাকে, জোর করেই ইউরোপিয়ানদের পাপের বোঝা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। জায়নবাদের মতো একটি জঘন্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ তৈরি করে পৃথিবীর অল্প সংখ্যক ইহুদির জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছে। আর এই জায়নবাদের বলি হতে হয়েছে নিরীহ ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীদের।
শত শত বছর ধরে যে ভূমিতে এই জনগোষ্ঠী প্রজন্মান্তরে বেড়ে উঠেছে, সেই ভূমিতেই আজ তারা অনাহূত। আরব বিশ্বে পশ্চিমাদের পাহারাদার রাষ্ট্র ইসরায়েল আজ তাদেরকে চরম মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে জায়নবাদের এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসন মুখ বুজে মেনে নেয়নি সাহসী ফিলিস্তিনি আরবরা। তারাও দিনের পর দিন পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যার আপাত সর্বশেষ নজির, এ বছরের অক্টোবরে অধিকৃত গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এই হামলার পর দীর্ঘদিনের সংঘাত আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এই সংঘাতে আবার অশান্ত হয়ে ওঠার শঙ্কায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য।
আজ থেকে শত বছরের বেশি সময় আগেই জায়নবাদের ভিত্তি তৈরি হয়। এই ভিত্তি তৈরিতে কীভাবে পশ্চিমারা ইন্ধন জুগিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে লেখা ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোরের লেখা একটি চিঠিতে। তিনি ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর লেখা এই ছোট পত্রটিতে লিখেছিলেন, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুন্ন করতে পারে।’ এটি কালক্রমে বালফোর ঘোষণাপত্র নামে পরিচিতি পায়।
জায়নবাদীদের এই ঘৃণ্য তৎপরতার জন্য আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল বাইবেলের একটি কল্পকাহিনির। তারা এই কল্পকাহিনিকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছিল। বালফোরের মতো ইংল্যান্ডের বুনিয়াদি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরাক্রমশালী প্রতিনিধিত্বকারীও জানতেন, যুগের পর যুগ ধরে নিজ ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের বিতাড়িত করে ধর্মগ্রন্থভিত্তিক কল্পকাহিনি আশ্রিত এক মিথ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা অপরাধ। কিন্তু তারপরও জেনেবুঝে বালফোর অপরাধটি করেছিলেন। এ জন্য তার ও তার সহযোগীদের কোনো পরিতাপ ছিল না। কেননা পশ্চিমাদের ইহুদি নিধনের পাপকে আড়াল করার আর কোনো উপযুক্ত পথ তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। আর পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যে ভরা আরব বিশ্বের ওপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাহারাদার তৈরির আকাঙ্ক্ষা।
এই বালফোর ঘোষণার তাৎপর্য বেড়ে যায় এ জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ ম্যানডেটরি প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে, যা চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। এটি ছিল জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের ভূখণ্ডে, যেখানে আজকের ইসরায়েল অবস্থিত।
এরপর শুরু হয় ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে পাড়ি জমানো। এর মধ্যেই ১৯৩৯-৪৫ কালপর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল আর জার্মানিতে হিটলারের চরম ইহুদিবিদ্বেষ জায়নবাদীদের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদি নিধন করা হয়, যা ইতিহাসে হলোকাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। যুদ্ধ শেষে এই হলোকাস্টই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি স্থাপনের সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরা হয়।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জায়নবাদীরা যে পাপের সূচনা ঘটিয়েছে, তা একাধারে অপরাধ ও দখলদারির মধ্য দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিস্তৃত হয়ে আসছে। এ জন্য ৭৫ বছর ধরে জায়নবাদীরা প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি শুধু ঘটায়নি, বরং বাছাই করা সত্য ও সযত্নে তৈরি মিথ্যার সুদক্ষ মিশেলে নিজেদের অপকর্মের বৈধতার জন্য বিভ্রান্তিকর ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্ব বেমালুম এটা ভুলে যায় যে ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, অথচ ক্ষতিপূরণের জন্য মূল্য গুনতে হচ্ছে আরবদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়া হয়।
এদিকে জায়নবাদীরা নিজ ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কেটে ফেলে। প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বেন গুরিয়ান ১৯০৬ সালে অটোমান ফিলিস্তিনে অভিবাসী হয়ে আসেন এবং কট্টর জায়নবাদী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশদের শাসনাধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, যাতে নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত আরবেরা সুরক্ষা না পায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh