বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভধ্বনি ও ইসরায়েলি বধির বাহিনী

যে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মহাভাঙন (কিংবা স্বাধীনতা) ঘটেছিল, ঠিক একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে মহা-আগ্রাসন হয়েছিল। ছয় মাসের মাথায় ১৫ হাজার মানুষের প্রাণনাশ করে, আট লাখ ফিলিস্তিনিকে চরম নির্যাতন ও উচ্ছেদ করে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র হয়েছিল ইসরায়েল। নিজের ভিটা ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবন, সে যে কী ভীষণ যাতনার, ফিলিস্তিনিরা তখন থেকেই এমন অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এরপর ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে চার লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়। সেই সময় থেকে পুরোই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গাজা উপত্যকা। আর পশ্চিম তীরে তো অবৈধ বসতি স্থাপন চলছেই। 

দীর্ঘ ৫৬ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের ‘জবাব’ দিতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে অতর্কিতে হামলা চালায় হামাস, যারা ২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করে আসছে। সেদিন এক উৎসবে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিল, বিদেশি নাগরিকও ছিল অনেক। হামাসের ওই হামলায় সাড়ে ১১শর মতো মানুষ নিহত হয়; এদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল অনেক। পাশাপাশি, আড়াইশর মতো মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাসের যোদ্ধারা। ওই দিন থেকেই গাজায় সামরিক আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। সাড়ে সাত মাসে তাদের হামলায় ৩৬ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণ ঝরেছে। এদের মধ্যে অর্ধেকই নিরীহ ও নিরস্ত্র শিশু।

ফিলিস্তিনে ২০-২২ লাখ মানুষের বসবাস। এই যুদ্ধের সময় এদের প্রায় সবাইকে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। একবার নয়, কয়েক দফায়। উত্তরে হামলা হলে দক্ষিণে, আবার দক্ষিণে হামলা হলে উত্তরে। পূর্ব গাজায়ও আশ্রয় নিয়ে পরে হামলার মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষেরা। সীমানা ঘেরাও করে, অবরুদ্ধ রেখে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল। 

বিমান হামলা যেমন করছে, পাশাপাশি গাজার ভূ-অভ্যন্তরে ঢুকে স্থল হামলাও করছে যুদ্ধবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে গাজার শিক্ষালয়, উপাসনালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র-কিছুই বাদ যায়নি আগ্রাসনের হাত থেকে। চলতি সপ্তাহেই আল আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার পুড়িয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোস্তাফা সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গ্রন্থাগারে একজন সেনা একটি বই হাতে নিয়ে দেখছেন, আর তার পেছনে বইয়ের তাকে আগুন জ্বলছে। স্পষ্টভাবে এ হলো সাংস্কৃতিক গণহত্যা। 

ইসরায়েল আসলে ভয় পায় স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের লেখনীকে। তাই সৃজনশীল লেখক ও ভবিষ্যতের সৃজনীসত্তাকে হত্যা করার পাশাপাশি অতীতের সব লেখা-যার মধ্যে নিশ্চয়ই আছে স্বাধীনতার রূপরেখা-পুড়িয়ে ফেলছে তারা। বই পোড়ে, কিন্তু পাণ্ডুলিপি পোড়ে কি? ফিলিস্তিনিদের শরীর শেকলে বেঁধে রাখা যায়, সীমানা বন্ধ রেখে অবরোধ করা যায়; কিন্তু স্বাধীনতার চেতনাকে খুন করা যায় না। ইসরায়েল তা পারবে না। কিন্তু ইসরায়েল সেই অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেই। আরও বিধ্বংসী রূপে। আরও বর্বর চেহারায়।

নেতানিয়াহুকে থামানোর জন্য ঘরে ও বাইরে প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। একদিকে হামাসের হাতে এখনো জীবিত থাকা জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনার দাবিতে তাদের স্বজনরা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলে বিক্ষোভ করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া-বিশ্বের সব প্রান্তেই গাজায় গণহত্যা বন্ধে ও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে গণবিক্ষোভ হচ্ছে। ইহুদিরাও নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। আবার তারই যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা নেতানিয়াহুর গাজানীতির কঠোর সমালোচনা করছেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী নেতা ইয়ার লাপিদ বলেছেন, নেতানিয়াহুর কাছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমনকি ইসরায়েলের ভবিষ্যৎও না।

বিশ্বজুড়ে গণবিক্ষোভে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীবিক্ষোভে যুদ্ধবিরোধী স্লোগানগুলো কার না কানে বেঁধে। শোনা যায়, ‘এখনই যুদ্ধ থামাও’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’, ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন করো’, ‘ইসরায়েল নিপাত যাক’, ‘খুনি নেতা নেতানিয়াহুর বিচার চাই’। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কতবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান উঠল। জাতিসংঘের শীর্ষ ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে আগ্রাসন বন্ধের হুকুম এলো। কিন্তু লাখো ফিলিস্তিনির আহাজারি, বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভধ্বনি, আদালতের নির্দেশবাণী-কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ইসরায়েলের খুনি বাহিনী। এদের কেতাবি নাম ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। চরিত্রদোষে এদের নাম হওয়া উচিত, ইসরায়েল ডিফ ফোর্স বা ইসরায়েলি বধির বাহিনী। 

রোম সংবিধি মেনে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান আহ্বান জানিয়েছেন, গণহত্যার নায়ক নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে এবং (হামাসের তিন নেতাকে) গ্রেপ্তারে যেন পরোয়ানা জারি করা হয়। একে ‘নজিরবিহীন নৈতিক স্খলন’ বলে অভিহিত করেছেন নেতানিয়াহু। চোখ থাকতেও ইসরায়েলের বর্বরতা দেখতে পায় না যে যুক্তরাষ্ট্র, সে উল্টো হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আদালতটির বিরুদ্ধেই নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। এই যুক্তরাষ্ট্রই ভেটো দিয়ে জাতিসংঘে ওঠা ফিলিস্তিনের মুক্তি ও শান্তির প্রায় সব আহ্বান কণ্ঠরোধ করেছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //