ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে যখন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট চরমে, তখন মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল রেকর্ড ৬৯.৮ শতাংশে। পরের ১০ মাসে সেই মূল্যস্ফীতি ১০ গুণেরও বেশি কমিয়ে আনে দেশটির প্রশাসন। মুছে যাচ্ছে ঋণখেলাপির তকমাও। আর এই সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রাখছে বিশেষত দেশটির কৃষি ও পর্যটন খাত। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বৃহৎ খাত পর্যটন।
২০২২ সালের মার্চ মাস থেকেই কার্যত ভেঙে পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে পড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি। দেশের এ অবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করে বিক্ষোভে শামিল হন দেশটির সাধারণ মানুষ। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে তাণ্ডব চালান লঙ্কাবাসী। বেগতিক দেখে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। দীর্ঘদিন পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি ক্ষমতা পেয়ে অর্থনৈতিক কাঠামোর কোনো মৌলিক পরিবর্তনের দিকে যাননি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কাকে বিশাল অঙ্কের আর্থিক অনুদান দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির কঠিন শর্তে দেশটির মানুষের নাভিশ্বাস হলেও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় সেদেশের অর্থনীতি।
শ্রীলঙ্কার জিডিপির ১২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। একসময় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানী কলম্বোসহ কয়েকটি শহরের তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনার পর থেকে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা কমে যায়। তারপর শুরু হয় করোনা মহামারি, যা ছিল অনেকটা কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো। ২০২২ সালে শুরু হয় চরম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। তবে এর মধ্যেও পর্যটন খাতই ছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একমাত্র জীবন্ত অংশ। সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত। বর্তমানে দেশটিতে বিপুল সংখ্যক বিদেশি পর্যটক আসছেন শ্রীলঙ্কায়। ইউরোপ, আমেরিকার পাশাপাশি এশিয়ার চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক বাড়ছে।
দেশটির পরিসংখ্যান দপ্তর জানায়, গত বছরের শেষ নাগাদ পর্যটন খাত চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। এর পাশাপাশি প্রবাসীরাও রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশটিতে বিদেশি পর্যটক বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার। যেখানে এক বছর আগে ওই সময়ে পর্যটক এসেছিল ৯১ হাজার ৯০০ জন। দেশটির শীর্ষ স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি জেটউইংস সিম্ফনির প্রধান নির্বাহী হিরন কুরে বলেন, ‘আমাদের খাত যেন জাদুর মতো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, অথচ গত বছর আমরা জানতাম না, দেশ কোথায় যাবে।’
দেশটির সরকার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ডিসেম্বরে শেষ হওয়া প্রান্তিকে দেশটির কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি এসেছে ৪.৫ শতাংশ। যেখানে এক বছর আগের এই সময়ে অর্থনীতি ১২.৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ২০২৩ সালে দেশটির অর্থনীতি সার্বিকভাবে ২.৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ২০২২ সালে এই সংকোচনের পরিমাণ ছিল ৭.৮ শতাংশ।
দেশটির পরিসংখ্যান দপ্তর আরও জানায়, ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দ্বৈত পরিস্থিতিতে পড়ে। বছরের প্রথমভাগে অর্থনীতি সংকুচিত হলেও দ্বিতীয়ভাগে ঘুরে দাঁড়ায়।
পর্যটক আকর্ষণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন মন্ত্রণালয় দেশটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি দেশটি মিস ট্যুরিজম ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রাউন্ডের আয়োজন করেছিল, যেখানে ৩০টি দেশের প্রতিযোগীরা দ্বীপ রাষ্ট্রটি ঘুরে দেখেন। এই ইভেন্টটি শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
শ্রীলঙ্কা পর্যটকদের নিরাপত্তার দিকটি খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি পর্যটকদের সঙ্গে কেউ যেন খারাপ আচরণ না করে সে বিষয়েও দেশটির নাগরিকদের বারবার সচেতন করা হচ্ছে। কারও এ ধরনের কাজ শ্রীলঙ্কার সুনামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই পর্যটক ও পর্যটন খাতের স্বার্থ রক্ষায় দেশটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কথা ভাবছে। আর এতে দেশটির কোষাগারে বেড়েছে বিদেশি মুদ্রার পরিমাণও। আন্তর্জাতিক বাজারে শ্রীলঙ্কার মুদ্রার দরও বেড়েছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh