আবারও রোহিঙ্গা গণহত্যা

১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গারা নাগরিক ও সম-অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৬-২০১৮ সালের বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নির্মম আক্রমণ চালায়। ২০১৭ সালে বিশ্ব এক অভূতপূর্ব অমানবিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিধনে অভিযান শুরু করে। ২৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নিধনের জ্বলন্ত উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ দাবি করে বাস্তুচ্যুত করা হয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তবে প্রকৃতির নির্মম বাস্তবতায় যারা রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছিল, ৭ বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেই বর্ডার গার্ড পুলিশ সদস্যরাই আরাকান আর্মির আক্রমণে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে আরাকান রাজ্যের রাজধানী সিটুওয়ে ছাড়া কোনো এলাকাই জান্তাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে এবার আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গা নিধনের।

মিয়ানমারের বেশিরভাগ রোহিঙ্গা মুসলিম, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য রাখাইনে সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় রাখাইন জনগোষ্ঠী, আরাকান আর্মি এবং ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) ভূমিকা ছিল জটিল। রাখাইন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে দেখে এবং তাদের রাখাইন রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে স্বীকার করে না। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও পোশাক সরবরাহ করছে।

রাখাইন রাজ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সামরিক সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। আরাকান আর্মি প্রধানত রাখাইন জনগণের স্বার্থে কাজ করে; তারা আরসার মতো রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে ইচ্ছুক নয়। আরসার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত বৈরী এবং আরএসওর সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হলেও সহানুভূতির অবকাশ রয়েছে সামান্যই।

অপারেশন ১০২৭-এর পর আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক উঠেছে। অপারেশন ১০২৭ ছিল মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ও সমন্বিত বিদ্রোহী অভিযান। এ অপারেশনে আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) মিলে ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গঠন করে। এই অভিযান মিয়ানমারের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে বিদ্রোহীরা উত্তর শান রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ও বাণিজ্য রুটের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। জান্তাবাহিনীর মনোবলে ধস নামে এবং অনেক সেনা আত্মসমর্পণ করে বা পালিয়ে যায়। 

আরাকান আর্মির তরুণ নেতারা তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্ভাবনী কৌশলের মাধ্যমে সংগঠনকে পরিচালনা করছেন, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রোহিঙ্গারা নেই। তাদের আরাকানের অংশ হিসেবে মানতে চায় না আরাকান আর্মিসহ অন্য বিদ্রোহীরা। অপারেশন ১০২৭-এর প্রেক্ষাপটে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো। চাঁদাবাজি, নির্যাতন, জোরপূর্বক বাহিনীতে প্রবেশে বাধ্য করা, নারী নিপীড়নসহ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রোহিঙ্গারা। গত ৫ আগস্ট সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কয়েকশ মানুষ। তাদের ওপর ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে অন্তত ২০০ জনকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ফায়াজ ও তার স্ত্রী সেদিনের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, হাজার হাজার ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গা রাখাইনের মংডু শহরের কাছে নাফ নদীর তীরে পৌঁছে নৌকায় ওঠা শুরু করেছে তখনই তাদের ওপর ড্রোনের সাহায্যে হামলা শুরু হয়। ফায়াজ তাদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন, সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী এবং তিন সন্তান। ৮ মাসের ছোট সন্তান ছিল ফায়াজের শ্যালিকার কোলে। প্রথম গোলাটি মুহূর্তেই তার শ্যালিকার জীবন কেড়ে নেয়। কোলে থাকা ফায়াজ দম্পতির ছোট্ট শিশুটি মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরে মারা যায়। বাংলাদেশের উপকূলে বেশ কয়েকটি মরদেহ ভেসে এসেছে বলে জানা গেছে, যা এই গণহত্যার সময়কার বলে মনে করা হচ্ছে।

গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা জানান, তাদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে আরাকান আর্মি। প্রথমে তাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে পালাতে বাধ্য করা হয় এবং পালাতে গেলে নদীর তীরে আবারও হামলা চালানো হয় ড্রোন ও গোলাবারুদ দিয়ে। তবে আরাকান আর্মি হামলার দায় অস্বীকার করেছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh