তবুও পাকিস্তানের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ইমরান

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রায় এক বছর ধরে কারাবন্দি। তবে জনসমক্ষে না থাকলেও জনগণের মধ্যে ইমরানের প্রভাব আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। এখনো পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতির প্রভাবশালী শক্তি ইমরান। পত্রিকায়, সামাজিক মাধ্যম ও আদালতে তার নাম আসছে নিয়মিত; সমর্থকরা তার জন্য জান দিতে রাজি।

ইমরান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি এক বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তাদের মুক্তি পাওয়ার কোনো লক্ষণ খুব শিগগিরই দেখা যাচ্ছে না। তবে কারাগারে থাকা সত্ত্বেও যে ইমরান মাথা নত করেননি, সেই বার্তাই ইমরানের আইনজীবী ও তার পরিবারের সদস্যরা তুলে ধরছেন। ইমরানের বোন আলিমা খানম বলেন, ‘তার মধ্যে একটা সদম্ভ ব্যাপার আছে। তার কোনো চাহিদা নেই, কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আছে শুধু একটা উদ্দেশ্য।’ কারাগারে এক মিনিটও সময় নষ্ট করছেন না বলে জানিয়েছেন ইমরান। এটা তার কাছে আরও জ্ঞান অর্জন করার একটা সুযোগ বলে উল্লেখ করেন আলিমা।

শুধু ইমরানের বোন নন, অন্য যারা দেখা করতে যান, তাদের মতে, এই সাবেক ক্রিকেট তারকার দিন শুরু হয় ব্যায়াম করার মধ্য দিয়ে, তিনি বই পড়েন এবং নিজের চিন্তাগুলো সাজিয়ে লেখালেখি করেন। কারাগারের উঠানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এক ঘণ্টার মতো সময় থাকে। পরিবারের কাছ থেকে তার চাওয়া একটাই নতুন বই সরবরাহ করা। এ নিয়ে মাঝে মাঝে ইমরান রাগ করেন বলেও জানা যায়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ইমরান জেল থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবেন এবং তিনি সে রকম কিছু একটা করবেন বলে কোনো প্রত্যাশা ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী হলো পর্দার আড়ালে থাকা আসল শক্তিশালী খেলোয়াড়। তারা যখন সিদ্ধান্ত নেয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বন্দি রাখার, তখন তারা চট করে শান্ত হয় না। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে।’

সম্প্রতি কারাগার থেকে দেওয়া এক বার্তায় ইমরান সেনাবাহিনীকে ‘পাকিস্তানের মেরুদণ্ড’ উল্লেখ করে তাদের নিরপেক্ষ থাকতে বলেছেন, যাতে দেশ চলতে পারে। এই বার্তাকে ‘শান্তি সমঝোতা’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। ইমরান যে আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন সেটাকে অনেকেই সামরিক বাহিনীর কাছে রাখা ‘শর্তগুলোর’ মধ্যে একটা বলে মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, এটি খুব বাস্তবসম্মত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইমরান কিছুটা নমনীয় হতে পারেন। পাকিস্তানি রাজনীতির একটা বাস্তবতা হলো, যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, তবে সেনাবাহিনীর অনুগ্রহে থাকতে হবে। অন্তত একেবারে বিপক্ষে চলে গেলে হবে না।’ তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত এখনো দেখা যায়নি। অনেক বিশ্লেষকের মতে, প্রথম দিকে সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু চিত্রটা একেবারে বদলে যায় ২০২১ সালে। ২০২২ সালে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর গত বছরের ৯ মে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন তার সমর্থকরা। এর মধ্যে কোনো কোনো বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে এবং একাধিক সামরিক ভবনে হামলা চালানো হয়। এই তালিকায় লাহোরের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার সরকারি বাসভবনও ছিল, সেখানে লুটপাট চালানো হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর থেকে পাকিস্তানের মিডিয়ায় ইমরানের ছবি দেখানো, তার নাম নেওয়া বা কণ্ঠস্বর বাজানো বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। ভোটের মাত্র কয়েক দিন আগে এই নেতাকে তিন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ সাজার মেয়াদ ছিল ১৪ বছরের। নির্বাচনের সময় ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রার্থীদের অনেকেই হয় কারাগারে ছিলেন অথবা আত্মগোপন করেছিলেন। ওই দলের ক্রিকেট ব্যাটের প্রতীক চিহ্নও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ৫৮ শতাংশ সাক্ষরতার দেশ পাকিস্তানে এই দলের প্রতীক সুপরিচিত ছিল।

পিটিআইয়ের সব প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই দলের অন্দরমহলেও তেমন আশার আলো দেখা যায়নি। তবে ব্যাপক জনসমর্থনের ফলে ইমরানের সমর্থিত প্রার্থীরা অন্যদের তুলনায় বেশি আসন জিতেছেন। ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগও উঠেছিল। পাকিস্তানের মূলধারার প্রায় সব প্রধান দল জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে। আর তার পেছনে ছিল সামরিক প্রশাসন। ইমরানই প্রথম নেতা যিনি সরাসরি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে টিকে আছেন। সামরিক বাহিনী নিজের ইচ্ছামাফিক সব করতে পারেনি। আর এ কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইমরানই তাদের ভরসা। তিনি সামনে না থাকলেও তার নামে উজ্জীবিত হচ্ছে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। ইমরানের দৃঢ় অবস্থান আর চলমান অচলাবস্থাই সামরিক শাসনের বাইরে আসার একমাত্র পথ বলে মনে করছেন বেশিরভাগ পাকিস্তানি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //