চাগোস দ্বীপপুঞ্জ

ভারত মহাসাগরে অস্ত গেল ব্রিটিশ-সূর্য

বলা হয়ে থাকে- ব্রিটিশ-সূর্য কখনো অস্তমিত হয় না। তবে এবার ভারত মহাসাগর থেকে একেবারেই অস্তমিত হতে যাচ্ছে ব্রিটিশ-সূর্য। চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের হাতে তুলে দিতে চলছে যুক্তরাজ্য। এর মধ্য দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে ভারত মহাসাগর থেকে ব্রিটিশ শাসনের অধ্যায়।

অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পর ভারত মহাসাগরের বিতর্কিত চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব অবশেষে মরিশাসের হাতে তুলে দিতে চলেছে যুক্তরাজ্য। কয়েক বছরের আলোচনার পর একটি চুক্তির আওতায় এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য দ্বীপপুঞ্জটি মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করবে। চুক্তিটি এখনও চূড়ান্ত হওয়া বাকি। তবে দুই পক্ষই যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি চূড়ান্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এটি সেন্ট হেলেনা, মরিশাস ও মালদ্বীপের মধ্যে পড়ে। এটি মোট ৬০টি দ্বীপ এবং প্রবাল দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যার মধ্যে প্রধান দ্বীপ হচ্ছে- দিয়েগো গার্সিয়া, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগই প্রবাল দ্বীপ এবং তা সমুদ্রের উপকূলে একটি উষ্ণ ও ন্যূনতম প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছে। 

চাগোস দ্বীপপুঞ্জের মোট এলাকা প্রায় ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, তবে বাসযোগ্য দ্বীপের সংখ্যা খুব কম। 

১৭ শতক থেকে চাগোস দ্বীপপুঞ্জে জনবসতি স্থাপন হয়। মূলত ভারত ও আফ্রিকা থেকে ক্রয় করা দাসদের মাধ্যমে ফ্রান্স এই অঞ্চলে জনবসতি স্থাপন করে। তবে যুক্তরাজ্য ১৯৬৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৩ সালে এই অঞ্চল থেকে দাসদের বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চলে ইজারা নিয়ে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ফলে এই অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত অবস্থানে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো স্থানে সামরিক অপারেশন পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয়। 

বহিষ্কৃত হওয়ার পর চাগোস অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে চাগোসিয়ানদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। যখন মরিশাস একটি ফরাসি উপনিবেশ ছিল, তখন দ্বীপগুলো মরিশাসের (ইলে মরিস) ফরাসি প্রশাসনের কর্তৃত্বে ছিল। পরে ফ্রান্স ১৮১৪ সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে মরিশাস অঞ্চলের দ্বীপগুলোর কর্তৃত্ব যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করে।

১৯৬৫ সালে মরিশাসের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করার সময়, যুক্তরাজ্য চাগোসকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশান টেরিটরি (বিআইওটি) হিসেবে গঠন করে। মরিশাস ১৯৬৮ সালে স্বাধীনতা পেলেও চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়নি। তাই যুক্তরাজ্যের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে মরিশাস চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে দাবি জানাতে থাকে। এর পর ২০২২ সাল থেকে ভারতের সমর্থন নিয়ে এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব অর্জনে মরিশাস ফের জোর তৎপরতা চালায়। ১২ দফা বৈঠকের পর অবশেষে এই দ্বীপপুঞ্জকে সার্বভৌমত্ব দিতে সম্মত হয় যুক্তরাজ্য। 

এর আগে অবশ্য ২০১৯ ও ২০২১ সালে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্বে সমর্থন দিয়েছিল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ও ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল’ অব দ্য সি (আইটিএলওএস)। ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) একটি অবাধ্যতামূলক পরামর্শমূলক রায় জারি করে, যেখানে বলা হয়- ‘যুক্তরাজ্য যত দ্রুত সম্ভব তার চাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনের সমাপ্তি ঘটাতে এবং মরিশাসের উপনিবেশীকরণ সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করা উচিত।’ 

এই রায়ের পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাবনা অনুমোদন করে। ২০২১ সালে সমুদ্রের আইনের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তার এখতিয়ারের জন্য নিশ্চিত করেছে যে, ‘যুক্তরাজ্যের চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওপর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই’ এবং এভাবে দ্বীপগুলোকে মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করা উচিত।

আদালত ও জাতিসংঘের এই সমর্থনকে প্রথমে মেনে না নিলেও এবার চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে সার্বভৌমত্ব দিতে রাজি হলো যুক্তরাজ্য। তবে বেশকিছু শর্ত দিয়েছে তারা। এতে বলা হয়- দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে মার্কিন ও ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থাকবে। তবে দ্বীপপুঞ্জ থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ হাজার মানুষ ফিরতে পারবেন।

যেহেতু এ অঞ্চলে চীন, ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে তাই যত দ্রুত সম্ভব চুক্তিটির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উভয় পক্ষ।

চাগোসের বাসিন্দারা অবশ্য নিজেদের বাসভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সুরে কথা বলছেন না। তাদের কেউ কেউ মরিশাস ও সিশেলস-এ, আবার অনেকে সাসেক্সের ক্রলি-তে বাস করছেন। তাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ফিরে যেতে চান, আবার অনেকে যুক্তরাজ্যে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা চান। অন্যরা বলছেন, দ্বীপপুঞ্জের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh