করোনাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ভয়াবহ পরিমাণে। সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পরার কারণেই এমনটা হয়েছিল। তবে ২০২২ সাল নাগাদ সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে বিশ্ববাজার যখন আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল, তখন ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন এক সংকটের। কার্যত পশ্চিমা দেশগুলো এ যুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ায় এর ব্যাপকতা ক্রমাগত বেড়েছে। এরপর গত বছরের ৭ অক্টোবর শুরু হয় গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের আগ্রাসন। এ যুদ্ধ লেবাননে বিস্তৃত হয়। ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজার আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে।
গত ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে গত অক্টোবর মাসে খাবারের দাম ছিল গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যের মাসিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এফএও জানায়, গত অক্টোবর মাসে তা ১২৭.৪ পয়েন্টে পৌঁছেছে, যা আগের মাস সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২ শতাংশ এবং এক বছর আগের তুলনায় সাড়ে ৫ শতাংশ বেশি।
মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে বৈরী আবহাওয়া এবং জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা খাদ্য বাজারকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। উদ্ভিজ্জ তেলের মূল্যসূচক অক্টোবর মাসে ৭.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রধানত পাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী ও রেপসিড তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনটি ঘটেছে। শিশুদের প্যাকেটজাত দানাদার খাবারের মূল্যসূচক অক্টোবর মাসে ০.৯ শতাংশ বেড়েছে। শস্যের মূল্য ০.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গম-ভুট্টার প্রধান রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়ায় প্রতিকূল আবহাওয়া ও কৃষ্ণসাগরে আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে।
ব্রাজিলে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পরিবহন সমস্যার ফলে দেশীয় চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে ভুট্টার দামও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এর বিপরীতে এফএও সব ধরনের চালের মূল্যসূচক অক্টোবর মাসে ৫.৬ শতাংশ কমেছে। ভারতের চাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে এই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অবরোধের প্রভাব বিশ্বের খাদ্যশস্য উৎপাদনেও প্রভাব পড়ছে। কারণ পটাশ, অ্যামোনিয়া, ইউরিয়াসহ বিশ্বের রাসায়নিক সারের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। বিশ্বের সার রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ চীন ও রাশিয়ার দখলে। পশ্চিমা অবরোধের কারণে সারের জন্য রাশিয়ার প্রতি নির্ভরশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনে সংকট তৈরি হয়েছে।
ডেইরি ও দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্য ১.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২১.৪ শতাংশ বেশি। বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে পনির ও মাখনের মূল্যবৃদ্ধি এর মূল কারণ। যদিও গুঁড়াদুধের সূচক কমেছে। চিনির দাম অক্টোবর মাসে ২.৬ শতাংশ বেড়েছে। ব্রাজিলে ২০২৪-২৫ মৌসুমে দীর্ঘ খরার কারণে আখের ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় এমনটি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধিও আখের একটি অংশকে ইথানল উৎপাদনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে উৎপাদন তুলনামূলক কম হওয়ায় চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ব্রাজিলিয়ান রিয়াল দুর্বল হওয়ায় এই বৃদ্ধির হার কিছুটা সীমিত।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কম না হলেও মূলত সরবরাহ শৃঙ্খল সংকটের কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ দেওয়ায় বিশ্বে তেলের সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে তেলের দাম বেড়ে যায়। আবার গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ অভিযানের ফলে বিশ্বজুড়ে জাহাজভাড়া, ট্রাকভাড়াসহ পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংকটের ফলে সারের দাম বেড়েছে বিপুলভাবে, জ্বালানির খরচ বাড়ায় পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব খাদ্যের বাজার থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। আফ্রিকার বহু দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের রপ্তানির ওপর নির্ভর করে থাকায়, সেসব দেশেও তীব্র ক্রোধ ও হতাশা জন্ম দিয়েছে সর্বগ্রাসী জনরোষের।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রগ্রাম পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নিকট অতীতের উদাহরণও টেনেছিল। অর্থের অভাবে ২০১৫ সালে সংগঠনটি সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য খাবারের জোগান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ার পরই ইউরোপের ইতিহাসে বৃহত্তম উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হয়। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিতে জানিয়েছিল যে অনুন্নত দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র আকার ধারণ করছে, তাদের যদি সেই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মতো সামর্থ্য জোগানো না যায়, তবে আবার উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh