ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এক অস্থির সময় পার করছে বিশ্ব। বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সংঘাতের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরো জটিল হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও সামরিক হুমকি- প্রতিটি মহাদেশে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রভাব ফেলছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ গত কয়েক দশকের মধ্যে ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রাজনৈতিক নেতা এবং বিশ্লেষকদের নজর এখন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন একটা বড় সংঘাতের আশঙ্কায় অনেকেই শঙ্কিত। এতে এরই মধ্যে মার্কিন অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিও আরেক দফা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক যেকোনো উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয় খুবই দ্রুত। জ্বালানি সম্পদ, বাণিজ্য রুট,
ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির স্থায়ী মিত্রতার মতো বিষয়গুলোকেই অঞ্চলটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ হিসেবে দেখে থাকেন বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ও নীতিগত কড়াকড়িকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেছেন ৩৩ শতাংশ জরিপ অংশগ্রহণকারী। বছরে দুইবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেড। এতে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা হয়।
এবারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছেন এমন উত্তরদাতা গতবারের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখার হার ৭২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশে।
সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদ কয়েক দশক ধরেই মার্কিন নীতি নির্ধারণের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান পণ্য ও পরিষেবা বিশেষ করে সামরিক হার্ডওয়্যারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই অঞ্চলটিতেই সবচেয়ে বেশি মার্কিন অস্ত্র রপ্তানি করা হয়েছে। মোট মার্কিন অস্ত্র রপ্তানির ৩৮ শতাংশই গেছে মধ্যপ্রাচ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনেছে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও ইসরায়েল। এ ছাড়া সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান হিউ লোভাট। তিনি অঞ্চলটির ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) একজন বিশ্লেষক। লোভাট বলেন, ‘গাজা যুদ্ধের ফলে লোহিত সাগরে চলাচল করা জাহাজে আক্রমণ শুরু করে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। প্রতি বছর ১৭ হাজারেরও বেশি জাহাজ এই সাগর দিয়ে খাবার, ওষুধ, জ্বালানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন করে থাকে, যা বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ।’
যুক্তরাজ্য ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের নিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যৌথভাবে হুতিদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা আক্রমণ চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান মার্কিন বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাহরাইন, কাতার ও কুয়েতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসির থিংকট্যাংক দ্য উইলসন সেন্টারের মিডল ইস্ট প্রগ্রামের ডিরেক্টর মেরিসা খুরমা বলেন, ‘কোনো একক শক্তি যেন আধিপত্য বিস্তার করে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।’
ফেডের প্রতিবেদনে উত্তরদাতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হলো এই সংঘাত অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেউ কেউ সতর্ক করেছেন, এটি একটি বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। জ্বালানি সরবরাহ ও বৃহত্তর পণ্যবাজারে ব্যাঘাতের মাধ্যমে এ উত্তেজনা আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে বলে উত্তরদাতারা উল্লেখ করেছেন।
বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উত্তরদাতারা। তাদের মতে, শুল্ক প্রতিবন্ধকতা পাল্টা প্রতিরক্ষামূলক নীতিকে প্ররোচিত করতে পারে। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ও মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই উদ্বেগগুলো ট্রেজারি বাজারেও প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে ফেডের সুদহার কমানোর পরও ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড বেড়েছে।
ফেডের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার আরো বৃদ্ধি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে অস্থিরতা বাড়াতে পারে। উচ্চ সম্পদমূল্য এবং বাড়তে থাকা ভূ-রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের হঠাৎ ঝুঁকি এড়ানোর দিকে নিয়ে যেতে পারে। এতে সম্পদের মূল্য হ্রাস পেতে পারে, যা মার্কিন ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh