ইতিহাসে এমন অনেক নারী রয়েছেন, যারা তাদের সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্ব দিয়ে যুগে যুগে বিশ্বকে প্রভাবিত করেছেন। তবে জোয়ান অব আর্ক তাদের মধ্যে এক অনন্য নাম। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই তরুণী ফ্রান্সের মুক্তির যুদ্ধে যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তা আজও স্মরণীয়।
মধ্যযুগের ইউরোপে রাজনীতি, যুদ্ধ এবং ক্ষমতার মঞ্চ ছিল পুরুষদের অধিকারভুক্ত, সেখানে এক সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়ে হয়েও জোয়ান অব আর্ক প্রমাণ করেছিলেন, সত্যিকারের সাহস এবং সংকল্প কোনো বয়স বা লিঙ্গ মানে না।
১৪১২ সালে ফ্রান্সের ডমরেমি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জোয়ান। তার শৈশব ছিল সাধারণ, কিন্তু ১৩ বছর বয়সে তিনি একটি অলৌকিক স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নে তিনি শুনতে পান যে, তাকে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে ফ্রান্সকে ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পাঠানো হয়েছে। সে সময় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে চলছিল শত বছরের যুদ্ধ (১৩৩৭-১৪৫৩)। ফ্রান্সের বেশির ভাগ অঞ্চল ছিল ইংরেজদের দখলে। দেশের রাজা সপ্তম চার্লস তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
ঈশ্বরের আদেশে অনুপ্রাণিত হয়ে জোয়ান ১৪২৯ সালে রাজকুমার চার্লসের (ডফিন) সঙ্গে দেখা করতে যান। শুরুতে কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু তার অদম্য আত্মবিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতার সামনে সবাই নতি স্বীকার করে। তাকে ফ্রান্সের একটি সামরিক অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জোয়ানের নেতৃত্বে ফ্রেঞ্চ বাহিনী ইংরেজদের দ্বারা অবরুদ্ধ অরলিয়ঁ শহর পুনরুদ্ধার করে। মাত্র ৯ দিনের এই অভিযানে তার সাহস, সামরিক কৌশল এবং অনুপ্রেরণা ফ্রান্সের জনগণকে নতুন আশার আলো দেখায়। অরলিয়ঁর বিজয়ের পর জোয়ান অব আর্ক পুরো ফ্রান্সে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তাকে জাতীয় বীর হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই বিজয় শুধু সামরিক সাফল্যই ছিল না, এটি ফ্রান্সের রাজকীয় ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের সূচনা করে।
জোয়ান অব আর্কের সব যুদ্ধের পেছনেই ধর্মীয় চেতনা ছিল। এরপর জোয়ান ইংরেজদের সঙ্গে একটি যুদ্ধে লিপ্ত হলে রাজসভার ধর্মব্যবসায়ী যাজকরা রাজাকে বোঝান যে জোয়ানের এই ধর্মযুদ্ধ রাজাকে ফরাসিদের কাছে ‘ডেভিল’ এ পরিণত করবে। তৎক্ষণাৎ রাজা জোয়ানকে ডেকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বলেন। কিন্তু একরোখা এবং জেদি জোয়ান রাজার আদেশ অমান্য করেই যুদ্ধ চালিয়ে যান। ইংরেজরা যখন জানতে পারে রাজার কথা অমান্য করে জোয়ান যুদ্ধ করছে তখন রাজসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা জোয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। কঁপিএন শহরের বহির্ভাগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ডিউক অব বেডফোর্ডের নেতৃত্বে লড়াই করছিল, ১৫ আগস্ট তারা ফরাসি বাহিনীর মুখোমুখি হয়। প্যারিসে উভয় পক্ষের লড়াই হয়। জোয়ান এক পায়ে আঘাত পান। আঘাত নিয়েই তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান।
২৩ মে ১৪৩০ তারিখে সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাকে আটক করে ফেলে, বার্গুন্ডিয়ানরা তাকে ঘিরে ঘোড়া থেকে নামতে বাধ্য করে। প্রাথমিকভাবে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আটক অবস্থায় জোয়ান কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেন। একবার তিনি ৭০ ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে নিচের মাটিতে লাফিয়ে পড়ে বার্গুন্ডিয়ান শহর আরাসে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সরকার তাকে বার্গুন্ডিয়ান ডিউক ফিলিপের কাছ থেকে কিনে নেয়।
এক ইংরেজ ধর্মজীবী পাদ্রির অধীনে ১৪৩১ সালের ৯ জানুয়ারি তার বিচার কার্যক্রম আরম্ভ হয়। প্রহসনের এই বিচারে তাকে কোনো আইনজীবী দেওয়া হয়নি। বিচারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ‘তার ওপর ঈশ্বরের বিশেষ দয়া আছে’ তিনি এমন বিশ্বাস পোষণ করেন কি না। জবাবে জোয়ান বলেছিলেন, ‘যদি আমি তা বিশ্বাস না করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে যেখানে আছি সেখানেই রেখে দেন, আর যদি বিশ্বাস করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।’ আসলে এই প্রশ্নটিই ছিল সাংঘাতিক চালাকিপূর্ণ। যদি জোয়ান বলতেন ‘হ্যাঁ করি’, তবে তাকে ধর্মের বিরুদ্ধে যাবার অভিযোগ আনতেন আর যদি জোয়ান বলতেন ‘না’, তবে বলা হতো তিনি নিজের অভিযোগ নিজেই স্বীকার করেছেন।
ছলচাতুরীর বিচারে আদালত তাকে ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষি সাব্যস্ত করে। বিচারে তার কার্যকলাপকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করা হয়। আইনজীবী না থাকায় জোয়ানকে রায় বিস্তারিত পড়ে শোনানো হয়নি। জোয়ান তখন বুঝতেও পারেননি, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাগারে জোয়ানকে মেয়েদের পোশাক পরতে হয়। কয়েক দিন পর তাকে কারাগারের ভেতরেই লর্ড উপাধিধারী এক ‘সভ্রান্ত’ ইংরেজ ধর্ষণ করে। এর পর থেকে জোয়ান আবার পুরুষদের পোশাক পরিধান শুরু করেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল ছেলেদের পোশাকে নিরাপত্তা বেশি পাওয়া যেতে পারে, তা ছাড়া তার পরার জন্য অন্য কোনো বস্ত্র অবশিষ্ট ছিল না।
তারপর তাকে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। জোয়ান গির্জার যাজকদের কাছে একটি ক্রুশ চান। জনৈক চাষী একটি ছোট ক্রুশ তৈরি করে জোয়ানের পোশাকের সামনে ঝুলিয়ে দেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন মাত্র ১৯ বছরের এক তরুণী। যাকে বলা হতো ‘দ্য মেইড অব অরলিন্স’ বা অরলিন্সের কুমারী।
মৃত্যুর আগে তিনি ওই ক্রুশটি হাতে নেন। তিনি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করে দেন এবং তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেন।
জোয়ানের মৃত্যুর পর ইংরেজরা তার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরকে প্রদর্শন করে, যাতে কেউ কোনো দিন দাবি না করতে পারে, জোয়ান বেঁচে পালিয়ে গেছে। এরপর তার শরীর আরো দুইবার পোড়ানো হয়, যাতে তার ছাইগুলো এত মিহি হয়ে যায় যে কেউ তা সংগ্রহ করতে না পারে।
তার মৃত্যুর ২৫ বছর পর পোপ ক্যালিক্সটাস-৩ তার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ নতুন করে শুরু করেন এবং সেই বিচারে জোয়ান নিষ্পাপ ও সন্ত এবং শহীদ প্রমাণিত হন। অত্যাচারীদের বিচারে সে ডাইনি উপাধি পেলেও পৃথিবীর ইতিহাসে জোন অব আর্ক এক প্রেরণার নাম। তাই তো মৃত্যুর পরে নিষ্পাপ ও শহীদ হয়ে ইতিহাসে নতুনভাবে জন্ম নিয়েছে এই কিশোরী। পরবর্তী সময়ে তার স্মরণে ফ্রান্সে অনেক স্মৃতিসৌধও নির্মিত হয়েছে।
একসময়ের ডাইনি অপবাদের দায়ে পুড়ে মরা জোয়ান অব আর্ক আজ ফ্রান্সের জাতীয় বীর। ফরাসিদের জন্য তার এ আত্মত্যাগে তিনি হয়ে যান ইতিহাসের এক অন্যতম মহানায়িকা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh