কার্ল ডেনকে: এক মুখোশধারী নরখাদকের গল্প

প্রাচীনকালে সভ্যতার আলো থেকে দূরে থাকা জনগোষ্ঠীর মাঝে বর্বর মানসিকতার পরিচয় মেলে। এর ধারাবাহিকতায় আফ্রিকা ও আমাজনের কিছু অঞ্চলে এখনো আধুনিক সভ্যতা থেকে দূরে থাকা এমন কিছু জনগোষ্ঠীর দেখা পাওয়া যায়, যারা মূলত নরখাদক হিসেবে কুখ্যাত। তবে আধুনিক ইউরোপেও যে নরখাদক থাকতে পারে- এমন ঘটনার প্রত্যাশা না করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জানলে অবাক হবেন কার্ল ডেনকে নামে এমন এক নরখাদক ছিল যার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও সব অপরাধের বিস্তার ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে। 

প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৬০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ওবেরকুনজেন্ডরে জন্ম নেয় কার্ল ডেনকে। পরে ১০ বছর বয়সে সে পরিবারের সঙ্গে মুয়েনস্টারবার্গে চলে আসে। এখানেই তার বেড়ে ওঠা। মানুষের কাছে আপাদমস্তক ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত কার্লের এক ভয়ংকর নেশা ছিল মানুষের মাংস রান্না করে খাওয়ার! কার্লের ছোটবেলাটা আর দশটা বাচ্চার মতো সুখকর ছিল না। সহজ-সরল, কিন্তু একগুঁয়ে প্রকৃতির কার্লের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কিংবা কোনো কিছু আয়ত্ত করার মতো মানসিকতাই ছিল না। যার ফলে কার্লের প্রতি বিরক্ত ছিলেন তার স্কুলের শিক্ষকরা। এ জন্য প্রায়ই শাস্তি দেওয়া হতো তাকে। ১২ বছর বয়সে সে স্কুল ছেড়ে দেয়, চলে যায় বাড়ি ছেড়েও।  যুবক বয়সে একের পর এক ব্যর্থতা এসে হানা দেয় তার জীবনে। ২৫ বছর বয়সে বাবাকে হারায় কার্ল। এরপর পরিবার থেকে কিছু টাকা পেয়ে জমি কিনে চাষবাসের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়, বিক্রি করে দেয় জমি। তারপর একটা বাড়ি কিনলেও, মন্দার কারণে সেটাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় সে। একসময় তার মধ্যে একাকী থাকার প্রবণতা দেখা দেয়। 

ভয় কিংবা বিরক্তি এই দুটি ব্যাপার কখনোই ডেনকের মধ্যে দেখা যায়নি। এমনকি তাকে কখনো অতিমাত্রায় রাগ পর্যন্ত করতে দেখেনি কেউ। শহরের মানুষের কাছে ডেনকে পরিচিত ছিল তার ভদ্রতা, নম্রতা আর বিনয়ের জন্য। গরিবের ত্রাতা এবং দুর্দিনের সহায় ডেনকে ব্যক্তি পরিবার, সমাজ সব ক্ষেত্রেই ছিলেন দারুণ সমাদৃত। স্থানীয় চার্চে অর্গান বাজাত। চমৎকার আচরণের জন্য তার একটা ডাকনামও জুটেছিল, ঠিক ধর্মীয় যাজকদের মতো ‘ফাদার ডেনকে’।

তবে তার এই জনদরদী রূপের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর খুনি সত্তা। ৪০টিরও বেশি খুনের আসামি ছিলেন কার্ল; তবে শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হতেন না। মৃত ব্যক্তিদের হাড়-মাংস নিজে তো খেতেনই, শূকরের মাংস বলে বাজারেও বিক্রি করতেন! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বস্ব হারিয়ে তিনি নরমাংসের ব্যবসা শুরু করেন। আর সুস্বাদু মাংসের লোভে তার ক্রেতার কখনো কমতি হতো না।

১৯২৪ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে রক্তাক্ত শরীরে ছুটে আসেন এক লোক। ভিনসেনজ অলিভার নামের ভ্যাগাবন্ড প্রকৃতির লোকটি পুলিশকে অভিযোগ করেন কার্ল ডেনকে একটা কুঠার দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করেছে। তবে মুয়েনস্টারবার্গের মানুষ ডেনকেকে ভালো মানুষ হিসেবে চিনত। তাই শুরুতেই পুলিশ বিশ্বাস করেনি অলিভারকে। পরে ডাক্তারের মাধ্যমে অলিভারের আঘাত পরীক্ষা করে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে তাকে কোনো ভারী অস্ত্র দিয়েই আঘাত করা হয়েছে। এরপর ডেনকেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ডেনকে অলিভারের ওপর হামলার কথা স্বীকার করে জানান যে, চোর ভেবেই তার ওপর আঘাত করেছে সে। তবে নিজের এই দাবি প্রমাণের অপেক্ষায় থাকেনি ডেনকে। থানা হাজতে আটকে রাখার কয়েক ঘণ্টা পরেই ডেনকে আত্মহত্যা করে গলায় রুমাল পেঁচিয়ে।

ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ ডেনকের বাড়িতে তদন্ত চালায় পুলিশ। সে বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল টুকরো টুকরো মাংস আর হাড়। মাংসগুলো চুবানো ছিল একটা কাঠের ড্রামে লবণ মেশানো পানিতে। তিনটি পাত্রে পাওয়া গিয়েছিল রান্না করা মাংস, সঙ্গে ছিল ক্রিম সস। সেখানে আরো পাওয়া গিয়েছিল গামলাভর্তি চর্বি। সেগুলো পরীক্ষা করেও পাওয়া গিয়েছিল মানব প্রোটিনের অস্তিত্ব, মানে ওগুলো ডেনকের হাতে খুন হওয়াদের শরীর থেকেই নেওয়া। ডেনকের বাড়িতে, বাড়ির পেছনের জলাশয়ে আর সে শহরের ধারের এক বনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল মানব শরীরের বিভিন্ন অংশের অবশিষ্টাংশ। তার মধ্যে ছিল হাত, পা, ঊরু, গলা, বুকসহ মানুষের শরীরের প্রায় সব অংশের হাড়। আর পাওয়া গিয়েছিল ৩৫১ দাঁত। দাঁতগুলো রাখা ছিল একটা টাকার থলে, দুটো টিনের বাক্স আর তিনটি কাগজের ব্যাগের ভেতরে। টাকার থলেতে রাখা ছিল কেবল মাড়ির দাঁত, আর অন্যগুলোতে ছিল বাকি দাঁত। ছয়টি ছাড়া বাকি সব দাঁতই খুব ভালোভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল ডেনকে। অন্তত ২০ জন মানুষের দাঁতের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল সব মিলিয়ে।

ডেনকে তার খুন করা মানুষগুলোর চামড়া আর চর্বি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বানাত। মানুষের চামড়া দিয়ে বানানো হতো সাসপেন্ডার নামক লম্বা বন্ধনী। এ ছাড়া চামড়া আর চুল দিয়ে বানানো হতো দড়ি। চর্বি থেকে সাবান বানানোর চেষ্টার নমুনাও পাওয়া গেছে তার ঘর থেকে। তার ঘরে আরো পাওয়া যায় ৪১টি পুরোনো কাপড়ের পুঁটলিসহ ভিকটিমদের পরিচয়পত্র। কয়েকটা কাগজে ডেনকের হাতে লেখা ৩০ জন মানুষের নাম পাওয়া যায়। অর্থাৎ সেই তালিকার সবাই যে ডেনকের হাতে মারা পড়ে তার পেটে গিয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া হত্যার জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল তিনটি কুঠার, একটি বড় কাঠ কাটার করাত, একটি গাছ কাটার করাত, একটি পিকেক্স বা দুদিকেই ধারালো কুঠার আর তিনটি ছুরি। এই পিকেক্সটা দিয়েই অলিভারের ওপর হামলা করেছিল ডেনকে।

সবার কাছে এমন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ডেনকে কেন এই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে পুলিশ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। এমনিতে মানুষের ক্ষতি করার ইচ্ছা না থাকলেও এমন নৃশংস কাজ সে হয়তো করেছে মূলত খাবারের চাহিদার কারণে। অনেক বেশি পরিমাণ খাবারের চাহিদা থাকায় সেটা মেটানোর আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে এই বীভৎস কাজে নেমে পড়েছিল সে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো টানা ১৫ বছর ধরে চালানো নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ মুয়েনস্টারবার্গের একটি মানুষও জানতে পারেনি। এমনকি তার প্রতিবেশীরাও টের পায়নি। তবে ডেনকের প্রতিবেশীরা সব সময় তার বাসা থেকে একটা বিশ্রী রকমের কড়া গন্ধ পেত। কিন্তু কেউ কখনো ভেতরে ঢুকে কী হচ্ছে তা দেখার আগ্রহ বোধ করেনি। গভীর রাতে তার বাসা থেকে হাতুড়ি পেটানো আর করাত দিয়ে কী জানি কাটার শব্দ শোনা যেত। তবে তারা কখনো পাত্তা দেয়নি ডেনকের গভীর রাতের কাজকর্মকে।

শহরের মানুষের নিস্পৃহতার কারণেই ডেনকের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দিনের পর দিন এই জঘন্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া। সে রাতের বেলা ভারী বস্তা নিয়ে কোথায় যেত, আর কেনই বা খালি হাতে ফিরে আসত সেটা নিয়েও কারো মাথাব্যথা হয়নি। সে যেসব পুরোনো জামা-জুতা বিক্রি করত বাজারে, সেগুলোই বা কোথা থেকে আসত, সেটা নিয়েও কারো মনে সন্দেহ জাগেনি। কারো কারো মনে ডেনকের চলাফেরা নিয়ে একটু সন্দেহ থাকলেও সে যেহেতু শহরের অধিবাসীদের কারো ক্ষতি করেনি, তাই সেটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও হয়নি। এই সুযোগে ডেনকে তার নৃশংসতা চালিয়ে গিয়েছিল বছরের পর বছর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh