ট্রাম্প যুগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কোন পথে

দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রায় অর্ধশত নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এসব আদেশে অভিবাসন, পরিবেশ, লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান নীতিগুলো বদলে দেওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। বিপর্যয়কর মূল্যস্ফীতির অবসান, শুল্ক আরোপ, বড় ধরনের কর হ্রাস, নিয়মকানুন প্রবর্তন ও সরকারের আকার নিয়ে তার এজেন্ডা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। তার মতে, এসব অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে যেমন গতি আসবে, তেমনি ফিকে হয়ে যাওয়া আমেরিকান ড্রিম বা স্বপ্ন আবার রঙিন হবে। এটিকে অনেকে ‘ট্রাম্পবাদ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। যদিও অর্থনীতি নিয়ে তিনি যেসব বড় অঙ্গীকার করেছিলেন, সে রকম কোনো নির্বাহী আদেশে এখন পর্যন্ত সই করেননি। তবে শিগগিরই তা হতে যাচ্ছে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গতি হারাতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

ট্রাম্প এমন একসময় ক্ষমতায় বসলেন, যখন মার্কিন অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গবেষণা সংস্থা জে পি মরগ্যানের প্রধান বৈশ্বিক কৌশলবিদ ডেভিড কেলির মতে, ট্রাম্প উত্তরাধিকার সূত্রে একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি পেতে যাচ্ছেন। ফুটবল ম্যাচের আগে কৌশল সম্পর্কে প্রতিপক্ষকে অন্ধকারে রাখতে হয়। কিন্তু অর্থনীতির বেলায় পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। তা না হলে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করবে এবং পরিণামে অর্থনীতির গতি কমে যেতে পারে।

এখন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার মাত্র ৪.১ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি। সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির হারও আশাতীত। ২০২২ ও ২০২৩ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই মূল্যস্ফীতি এখন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়ে গেছে। এমনকি আবারও তা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কাও আছে। মূল্যস্ফীতির হার কমলেও ট্রাম্প জানেন, মার্কিন জনগণের মূল আক্ষেপ হচ্ছে পারিবারিক ব্যয়। মুডিস অ্যানালিটিকসের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় এখন একই পণ্য কিনতে মার্কিন ভোক্তাদের এক হাজার ২১৩ ডলার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা মন্দ নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মার্কিন অর্থনীতি যদি গতি হারায়, তাহলে তা হবে ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডজনিত অনিশ্চয়তার কারণে- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আটলান্টিকের পূর্ব ও পশ্চিমের, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপ এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপের মধ্যে চলমান গভীর বাণিজ্য, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে ‘ট্রান্স-আটলান্টিক পার্টনারশিপ’ বলা হয়। ইউরোপের সঙ্গে এমন অংশীদারি থেকে সরে এলে পশ্চিমা অর্থনীতি নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত হবে। ট্রাম্পের আগমনে প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত বাণিজ্য 

ট্রান্স-আটলান্টিক অংশীদারির সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে। বাইডেনের সময়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য সম্পর্ককে জোরালো করার অভিপ্রায়ে যে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি কাউন্সিল গঠিত হয়েছে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় এই কাউন্সিলের ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। 

ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব এবং ইউরোপের সঙ্গে চীনের ক্রমাগত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারত্ব বৃদ্ধি। অর্থাৎ ট্রাম্পের আগমনে চীন প্রশ্ন নিয়ে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিতে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় দফায়ও চীনকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। চীনের ওপর বড় আকারের শুল্ক আরোপের কথা ট্রাম্প এরই মধ্যে প্রকাশ করেছেন। চীনকে রুখতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে ইউরোপকে কাছে চান ট্রাম্প। গভীর অর্থনৈতিক অংশীদারির বাইরেও চীনকে ইউরোপ নিজের নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিবেচনায়ও দেখে থাকে। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে বৈদেশিক নীতির নতুন বিন্যাস ইউরোপকে চাপে ফেলতে পারে। চীন যেহেতু প্রযুক্তি ও বাণিজ্যনির্ভর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে, সেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বাভাবিকভাবে চীনকে তার বৃহৎ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে। ট্রাম্প যদি চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক হার বৃদ্ধি অব্যাহত রাখেন এবং একই সঙ্গে ইউরোপকে চাপে রাখেন, তবে ইউরোপের বাজার চীনা পণ্যে সয়লাব হবে।

ট্রাম্প যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট মুনাফা বাড়বে। তার অঙ্গীকারের মধ্যে আছে বাণিজ্য সংস্কার, কর হ্রাস ও সরকারি বিধিবিধানের রাশ আলগা করা। তবে অনেকে মনে করেন, ট্রাম্পের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। এতে ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হবে। নীতি সুদহার বাড়লে আবারও কষ্টের মধ্যে পড়বে মানুষ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh