দেবী সরস্বতী যখন ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় ঐতিহ্য

আজ সরস্বতী পূজা। শুরুতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। বিদ্যার দেবীর ধারণা আসে অনেক পরে। উর্বর নদী উপত্যকায় কৃষির ফলন ছিল পর্যাপ্ত। তাই সরস্বতী নদীতীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। সেই সূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী। 

সভ্যতার অভ্যুত্থান ও তার ক্রমবিকাশে নদী সব সময় সহায়ক ও সংগত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই কল্পনা করা যেতেই পারে সরস্বতী নদীর দুই কূলে সৃজিত পলল মৃত্তিকার উর্বর শস্যক্ষেত ছিল আর্য ঋষিদের ‘শস্যাগার’। জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা ভৌগোলিক সীমা রেখাকে অতিক্রম করে তার ডানা বিস্তার করেছে বিশ্বজুড়ে। মানব সমাজের এই বড় অস্ত্রটি বিশ্বজুড়ে উৎস নির্বিশেষে কাব্য-সাহিত্যের মুখবন্ধে, শিক্ষা আলোচনা ও শিক্ষাদানের শুরুতে, লোকসংস্কৃতির আসর বন্দনায় সুদীর্ঘকাল ধরে সরস্বতী বন্দনা একেবারেই অসাম্প্রদায়িক রূপে বিবেচিত হতো। তার দু-একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি লেটো গানের আসর বন্দনায় সরস্বতীকে 

‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

‘এসো গো মা সরস্বতী সর্বমঙ্গলা।

তোমার আসরে বাজে হারমনি বেহালা॥’

কবীরের লেখা ‘মধুমালতী’ কাব্যের সূচনায় সরস্বতী বন্দনা রয়েছে। জ্ঞানের আরাধনার এটি বহিঃপ্রকাশ বটে।

‘সরস্বতীর পদে করম নমস্কার।

পৃথিবী হইল নৌকা সংসার অপার॥

শির রাখি প্রণমি এ পদে করতার।

গোপত থাকিয়া কর মহিমা তোমার।’

মুসলমান কবিরাও সংস্কৃতির এই রীতিকে মেনেই কাব্য রচনা করেছেন। বিদ্যা নিকেতনে সরস্বতী পূজাও সেই আবহমান কাল ধরে প্রচলিত সংস্কৃতির এক পরম্পরা, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার যোগ আনাটাই অনুচিত, বরং তা হবে নতুন এক সাম্প্রদায়িক কাজ। 

সরস্বতী নদীর তীরে পাললিক মৃত্তিকায় উর্বর কৃষি ও উন্নত জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি ও সংস্কৃতিতে একটি নদী হয়ে গেল দেবী। এটি জ্ঞানচর্চার নিশ্চিত উত্তরাধিকার।

আর তাই, সরস্বতী বন্দনা ধর্মীয় যত না, তার চেয়েও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অন্নদামঙ্গল কাব্যে সরস্বতী বন্দনায় বলা হয়েছে, ‘তোমার করুণা যারে/সবে ধন্য বলে তারে/গুণিগণে তাহার গণন।’

শিল্পী ও বিদ্যার্থীরা চান তাদের জীবনের দুঃখনিবৃত্তি। শিল্পজীবনে ও বিদ্যার জগতে আপাত প্রতিষ্ঠাই এই দুঃখ নিবারণ করতে সক্ষম। লাভ হতে পারে জীবনে চলার পাথেয়। তাই কাব্য-সাহিত্যের জগতে লোকসংগীত ও লোকনাট্যের আসর-বন্দনায় সরস্বতীর স্তবস্তুতি করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই রীতি মানা হচ্ছে, আধুনিক লোককবিরাও তা অনুসরণ করে থাকেন। 

মঙ্গলকাব্যে সরস্বতী-বন্দনা তো আছেই। মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সরস্বতী-বন্দনায় ব্রতী হয়েছিল। কেউ আপত্তি করতে আসেনি, বন্দনার জন্য কেউ মারধর খেয়েছেন এমন কথা শোনা যায়নি। পুরো বিষয়টিই যে অসাম্প্রদায়িক ছিল। লোকসংস্কৃতির আঙ্গিকটাকে মান্যতা দিতে গিয়ে এটি করা হতো। এই ঔদার্য অপরিহার্য শিল্প-সংস্কৃতির সুরম্য জগৎ নির্মাণে। 

বাঙালির মনন ও মানস গঠনে ঐতিহ্যের রয়েছে বড় ভূমিকা। আমাদের সম্মিলিত মাছ ধরার জন্য বিলে নামার উৎসব, জামাই আপ্যায়ন, পিঠাপুলির আয়োজন ইত্যাদি বহু আগেই সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আমরা নববর্ষের আয়োজন বা ফলাহারের প্রত্যয়ে খুঁজে পাই। যেকোনো উপলক্ষে প্রতিবেশীকে সাধ্যমতো আপ্যায়নের চিরাচরিত প্রথা আমরা এই জটিল অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সময়েও ভুলতে নারাজ। এটি নতুন কিছু নয়। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির চিহ্ন এটি।

ওঝাদের মন্ত্রে বাদ যান না দেবী সরস্বতী; কখনো দেখা যায় এই ঝাড়ফুঁকের মন্ত্র মুসলমান লোক-চিকিৎসকও ব্যবহার করেন। অক্ষয় কুমার কয়াল সংগৃহীত একটি ঝাড়ফুঁক মন্ত্র এই রকম‘আকর্ণ পুরি এ জুড়ি বাল্মীকির বাণ।’

দেবতা অসুর কাঁপে নাহি সহে টান॥

ইন্দ্রের ঘরনি কাঁপে পাতালে বসুমতী।

চৌষট্টি ভৈরবী কাঁপে লক্ষ্মী-সরস্বতী।

বাংলার প্রাচীন ছড়ায়ও সরস্বতীর কথা আছে। 

‘ধলা মাইয়া সারিন্দা হাতে

সোনার বরণ কলসি কাঁখে

পাশে বইস্যা প্যাঁচা।’

আবার ‘সরস’ শব্দের অপর অর্থ ‘জ্যাতি’। ঋগবেদে সরস্বতীকে পাওয়া যায় অগ্নিরূপ, জ্যোতির্ময়ী এক দেবী রূপে। সরস্বতীর মধ্যে সূর্যকিরণের সপ্তবর্ণের ধারণা VIBGYOR এখানে পরিষ্কার। যেহেতু উদ্ভিদ দেহে বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণের অপরিহার্য শর্ত আলোক ও জল, সরস্বতী তাই সালোকসংশ্লেষ বা Photosynthesis প্রক্রিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৌরশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলের আবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, জলের সরবরাহকারিণী দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাই কৃষি উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

‘শ্রী’ অর্থে লক্ষ্মী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে একসময় হয়তো লক্ষ্মীপূজাই হতো, এখনো অনেক পরিবারে দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীকেও ভক্তি সহকারে ফুল নৈবেদ্য দেন। আর এই দিনটি থেকেই যেন শুরু হয় মুকুল-বিকাশের পর্ব, বসন্তের সৌকর্য, সুপ্তির অবসান, মনের মুক্তির মৌসুম।

দেবী সরস্বতী উপাসনায় লাগে পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব; ধান, যব, গম, মুগ ও তিল দিয়ে এই পঞ্চশস্যের অর্ঘ্য রচিত হয় আর আম, অশোক, অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুরের টিপ দিয়ে সাজানো হয় পঞ্চপল্লব।

পলাশপ্রিয়া হলেন দেবী সরস্বতী। পলাশের রক্ত রং উর্বরতার প্রতীক। দেবী সরস্বতী তাই উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী রূপে পূজিতা। তিনি জলের দেবী, আলোর দেবী ও উর্বরতার দেবী।

পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া। এই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মুসলমান, ১০.৪ শতাংশ খ্রিস্টান, ১.৭ শতাংশ হিন্দু এবং ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ। এই দেশটি তাদের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দেবী সরস্বতীকে স্থান দিয়েছে। ঐতিহ্যকে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র ১.৭ শতাংশ জনসংখ্যা কোনো রকম বাদ সাধেনি তাদের নীতিনির্ধারকদের।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস এভিনিউতে রয়েছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। দূতাবাসগুলো তাদের অঙ্গন সাজিয়েছে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী বীর, প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের মূর্তি দিয়ে। উদ্দেশ্য দেশজ গৌরব ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরা। এই ‘অ্যাম্বাসি রো’তে ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে স্থাপন করা হয়েছে স্যার উইন্সট্যান চার্চিল, ভারতীয় দূতাবাসের সামনে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি মূলত দেশের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরে। এখানেই ইন্দোনেশীয় দূতাবাস দেবী সরস্বতীর ১৬ ফুট উঁচু একটি প্রতিমা স্থাপন করেছে, যেখানে নিচে বই পাঠরত তিনটি শিশুর মূর্তিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। 

ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রদূত ডিনো প্যাট্টি জালাল বলেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপহার হিসেবে এনেছি।’ তিনি বলেন, ‘সরস্বতী বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী। আমাদের শিশুরা বিদ্যা ও জ্ঞানের সন্ধানী। জাতীয় উন্নয়নে এটি আলোর দিশারী। সরস্বতীর শুভ্র কল্যাণময় মুখচ্ছবি সব দর্শকের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। তাই এই প্রতিমা উন্নয়ন আকাক্সক্ষী ইন্দোনেশিয়ার প্রতীক। আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাই বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জন-অধ্যুষিত দেশের ঐতিহ্য প্রকাশে সরস্বতীর এই স্থান যথাযথ। আমাদের রাষ্ট্রীয় ঔদার্য ও মহৎ লক্ষ্য এই প্রতিমা থেকে ফুটে ওঠে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সহমর্মিতা ও সৌহার্দের মাধ্যমে দেশের উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হবে এই আমাদের প্রত্যাশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্যের জগন্নাথ হল মাঠে সরস্বতী পূজার যে উচ্ছল আয়োজন তা দেখিয়ে আমরাও কি ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রদূতের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারি না?’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh