ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা ইয়াসির আরাফাতের রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে যখন লিখছি, তখন ফিলিস্তিনের রাফা শহরে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। রাফা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিপরীতে এই গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বের অগণিত সংবেদনশীল মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। প্রতিবাদের সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গন থেকে, শ্রমিক কারখানা থেকে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নেমে এসেছেন রাজপথে- ফিলিস্তিনের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে।
আরব সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে সামনে রেখে জায়ানবাদী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের মানুষের মুক্তির লড়াইকে জোরদার করতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’। এরও বছর চারেক আগে একই মতাদর্শকে ধারণ করে আরাফাতের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক দল ‘ফাতাহ’। এরপর ইয়াসির আরাফাত ক্রমে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। প্রায় তিন দশকের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘রেজ্যুলেশন-২৪২’ মেনে নেন আরাফাত। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে থাকেন। ২ এপ্রিল ১৯৮৯ থেকে আমৃত্যু ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আরাফাত। জীবনের শেষ দুই বছর আরাফাত ফিলিস্তিন অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে তার প্রধান কার্যালয়ে ইসরায়েলি সেনা দ্বারা গৃহবন্দি ছিলেন।
২৫ অক্টোবর ২০০৪, মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আরাফাত। এর কয়েক দিন পর আরাফাতের ইচ্ছায় এবং ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের আগ্রহে ফ্রান্সের একটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আরাফাতকে। সেখানে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১১ নভেম্বর ভোরে মৃত্যুবরণ করেন ইয়াসির আরাফাত। মৃত্যুর আগে আট দিন সংজ্ঞাহীন ছিলেন তিনি। আরাফাতের শেষ দিনগুলোতে যে কজন মানুষ তার কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন ফিলিস্তিনের ‘লায়লা শহীদ’। লায়লা সে সময় ফ্রান্সে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
২০১৯ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাফাতের রহস্যময় অসুস্থতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “তাকে প্যারিসে নিয়ে আসার সপ্তাহখানেক আগে আমি একটা ফোন পেলাম। ফোনটা করেছিলেন ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী। তিনি বললেন, যে ডাক্তাররা ইয়াসির আরাফাতকে দেখছেন, তাদের সবারই মত হলো যে এটা কোনো সাধারণ অন্ত্রের সংক্রমণ নয় এবং তার অবস্থা খুবই সংকটজনক। তাকে এখন হাসপাতালে পাঠানো খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কয়েক দিন পর যখন প্যারিসের কাছে সামরিক বিমানবন্দরে আরাফাতের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমি যা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, তা হলো তার গায়ের চামড়ায় ফোস্কা পড়েছে, যেমনটা রোদে পুড়ে গেলে হয়। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আবু আম্মার, আপনি খালি গায়ে রোদে বসেছিলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘কি বলছ লায়লা! আমি দুই বছর ধরে আমার অফিসে বন্দি, রোদ কোথায় পাব?’ তখন আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। ভাবলাম হয়তো তিনিই তার চামড়ার সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারেননি। তার দেহে এমন কোনো পরীক্ষা বাকি ছিল না যা ফরাসি ডাক্তাররা করাননি। কিন্তু কোনো সংক্রমণের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ডাক্তাররা বলছিলেন, মনে হচ্ছে যেন তার দেহে বাইরে থেকে কিছু একটা ‘অনুপ্রবেশ’ করেছে; কিন্তু তা যে কী এবং কোথায়, তা ডাক্তাররা বের করতে পারেননি।”
ফ্রান্সের হাসপাতালে প্রথম পাঁচ দিন আরাফাত বেশ ভালো ছিলেন। বিছানার ওপর নিজে নিজে উঠে বসতে পারছিলেন, তিউনিশিয়ায় থাকা তার মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ফোনও ধরছিলেন। এমনকি ফিলিস্তিনের অর্থমন্ত্রী সালাম ফায়াদকে ফোন করে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন তিনি।
লায়লা শহীদকে অর্থমন্ত্রী ফায়াদ বিস্ময়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি অ্যাকাউন্টের যে হিসাব দিচ্ছিলেন তা ছিল একেবারে নির্ভুল!’ নভেম্বরের ৩ তারিখ ইয়াসির আরাফাত সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন এবং পুরোপুরি কোমায় চলে যান। তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি। ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ভোরে তিনি মারা যান।
মৃত্যুর আগে করা এক্স-রে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা বলছিলেন, ‘ইয়াসির আরাফাতের গলা থেকে অন্ত্র পর্যন্ত ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছে যেন পুড়ে গেছে। যেন তিনি এমন কিছু খেয়েছেন, যাতে তার পরিপাকতন্ত্রের ভেতর দিকটা পুড়ে গেছে। চিকিৎসকরা আরাফাতের শরীরে আরেকটি সমস্যা ধরতে পেরেছিলেন, তা হলো রক্তে প্লেট কমে যাওয়া। নিরাময়ের লক্ষ্যে আরাফাতের ডায়ালিসিস করানো হয়েছিল এবং প্লেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই দিন পর নতুন রক্তেও প্লেট কমে যায়।’ ধীরে ধীরে আরাফাতের দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরাফাতের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল ‘নির্ণয় করা যায়নি এমন এক কারণে তার মৃত্যু ঘটেছে।’
আরাফাতের মৃতদেহের কোনো ময়নাতদন্ত করা হয়নি। ২০০৪ সালেই আরাফাতের পোশাকে ‘পোলোনিয়াম-২১০’ তেজস্ক্রিয় বিষের হদিস পাওয়া গিয়েছিল এবং আরাফাতের স্ত্রী সুহা আরাফাত বিষয়টির তদন্ত দাবি করেছিলেন। আরাফাতের মৃত্যুর ৯ বছর পর ২০১৩ সালে তার দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয় এবং সুইজারল্যান্ডে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সুইস বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় আরাফাতের দেহাবশেষে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ পোলোনিয়াম পাওয়া যায়। তবে বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছিলেন যে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন এ বিষয়ে।
আরাফাতের মৃত্যু কীভাবে হলো সে রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। আরাফাতের মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সারা বিশে^ ছড়িয়ে থাকা ইয়াসির আরাফাতের অসংখ্য ভক্ত বিশ্বাস করেন আরাফাতের মৃত্যুর পেছনে রয়েছে ইসরায়েলের হাত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh