পাটকল বন্ধের এক বছর
ইদানিং পাট নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। পাটকে বহুমুখী করার চেষ্টা হচ্ছে। পাটের ফাইবার দিয়ে কাপড় তো আগেই হয়েছে। এখন পাটের নৌকা, গাড়ি, আরও কত কী তৈরি হচ্ছে! কিন্তু দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে বেসরকারি কোম্পানির কাছে পানির দরে বেঁচে দেওয়া নিয়ে এই গবেষকরা ভাবছেন না। সে ভাবনা যেন কেবলই বঞ্চিত পাটকল শ্রমিকদের এবং পাটকল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যে সংগঠনগুলো লড়াই করে, তাদের। ‘ফাইট ফর জুট’ নামের একটি সংস্থার প্রচার করা লিফলেটে জানা গেছে, সংস্থাটি পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রচার চালায়। তাদের ওই লিফলেটে বলা হয়েছে; ‘১ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট তিন মাসে ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়!’
আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর আগে দেশের কত অংশে পাট চাষ করা হতো, সে পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই, তবে দেশের এমন কোনো জেলা ছিল না, যেখানে পাট চাষ হতো না। সে হিসাবে অনুমানে বলা যেতে পারে. দেশের চাষযোগ্য প্রায় পঞ্চাশভাগ জমিতে পাট চাষ হতো। আগে বলতাম পাট আমাদের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী কৃষি পণ্য, যাকে ‘সোনালি আঁশ’ বলা হতো। সেই সোনালি আঁশও এখন কৃষকের ‘গলার ফাঁস’ হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন পাটকল ধ্বংস করে সর্বশেষ ২৬টি পাটকল গত বছর ৩০ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা এমন বীরদর্পে করা হয়, যেন এতে করে দেশ বিরাট এক অর্থনৈতিক সাফল্য পেল! কখনো যন্ত্রাংশের অভাবে, কখনো বা টাকা আটকে যাওয়ার অজুহাতে পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এই কলগুলোতে যে শ্রমিকরা কাজ করে তারা গার্মেন্ট শ্রমিকের মতো ‘নাগরিক’ নন। তারা অনেকেই গ্রাম থেকে কাজ করতে আসে। কেউ কেউ মিলের শ্রমিক ছাউনিতে গরু-ছাগলের মতো মাথা গুঁজে থাকে। এই শ্রমিকরা গত কয়েক মাস ধরে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। গতর খাটা শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করছেন! বেতন কেন বকেয়া হবে? আর সেই বেতন পাওয়ার জন্য আন্দোলনই বা করতে হবে কেন?
খুলনার আটরা শিল্প এলাকার আলিম, ইস্টার্ন জুটমিল, যশোরের রাজঘাট এলাকায় জেজেআই ও কার্পেটিং জুটমিল ও খুলনা নগরের খালিশপুরে প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, স্টার জুটমিলের শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে নগরের নতুন রাস্তার মোড়ে যশোর-খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। সে সময় শ্রমিকরা টায়ারে আগুন ধরিয়ে সড়কে বিক্ষোভ দেখান। রেললাইনে লাল পতাকা উড়িয়ে দেন।
সারাদেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলের শ্রমিকরা কোথাও এক বছরের, কোথাও দেড় বছরের বকেয়া মজুরি পান না। ২৬টি পাটকল বন্ধের ফলে ২৫ হাজারেরও বেশি স্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন এক বছর হলো। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, স্থায়ী শ্রমিকদের আগামী দুই মাসের মধ্যে শ্রম আইন অনুযায়ী সব পাওনা ও সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এ জন্য সরকারের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। তবে অস্থায়ী এবং বদলি শ্রমিকরা এই বন্ধের ফলে বাড়তি কোনো সুবিধা পায়নি। এই করোনার মধ্যে ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হলো। তারা তাদের পাওনা পাবেন; কিন্তু আরও ১১ হাজার বদলি এবং অস্থায়ী শ্রমিক আছেন। তারা বেতনের বাইরে কোনো সুবিধা পায়নি।
করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর ২ জুলাই রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধের নোটিস টানানো হয়। ফলে স্থায়ী, বদলি ও দৈনিকভিত্তিক মিলিয়ে এক ধাক্কায় প্রায় ৫৭ হাজার শ্রমিকের কর্মক্ষম হাতকে বেকারের হাতে পরিণত করা হয়েছে। শুধু শ্রমিক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাটচাষি-পাটশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদার ও তাদের পরিবারসহ লাখ লাখ মানুষ।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সময় বলা হয়েছিল- ৩ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক-জনিত ক্ষতিপূরণসহ সব পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পাটকলগুলো পুনরায় চালু করা হবে; কিন্তু এক বছর হতে চললেও এখনো সব স্থায়ী শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ হয়নি। বদলি শ্রমিকদের পাওনা এখনো দেওয়া শুরুই করা হয়নি। করোনা মহামারিজনিত লকডাউনের মধ্যে বিকল্প কাজ ও আয়ের অভাবে এই শ্রমিকদের দুর্দশা বর্ণনাতীত। পাওনার টাকা হাতে পেলে এই অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে তারা কোনো মতে চলতে পারতেন।
পাটকলগুলোর শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার সীমা পরিসীমা নেই। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে শ্রমিকরা যে পরিমাণ টাকা ‘সপ্তাহ’ পান, তা দিয়ে তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস ‘সপ্তাহ’ না পাওয়ায় মানবিকভাবে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছে সারাদেশের পাটকলে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিক। তারা রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছেন। চাকরিচ্যুত পাটকল শ্রমিকদের সঙ্গে চলছে প্রতারণা। এ যেন শুভঙ্করের ফাঁকি।
বারবার বঞ্চনা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির শিকার হয়ে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে পাটকল শ্রমিকরা। দফায় দফায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ফলাফলও শূন্য। শ্রমিকরা ক্ষোভে বিক্ষুদ্ধ। রাজপথ-রেলপথে আন্দোলন অব্যাহত থাকায় জনদুর্ভোগ এখন চরমে। অথচ বিজেএমসি ঠুটোজগন্নাথের মত কেবলই সাক্ষী গোপাল। রমজানে পাটকল শ্রমিকদের সেহরি ও ইফতারিবিহীন মানবেতর জীবন কেবল শ্রমিক পরিবারেই প্রভাব ফেলেনি। বরং এই বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমজনতার প্রতিটি ঘরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাটকল শ্রমিকদের রাস্তায় ইফতারি আর মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র এখন ভাসছে। এরপর বলা হলো কোরবানি ঈদের আগে সব টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়নি। এখন অভুক্ত শ্রমিক পরিবারগুলো কোথাও অভুক্ত, কোথাও একবেলা আহার করে কোনো মতে বেঁচে আছেন।
বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোতে কাজ করত ৭৫ হাজার ৫০০ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। এর মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যা হচ্ছে ৭০ হাজার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ৫ হাজার ৫০০ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা না হলেও, ৭০ হাজার শ্রমিকের মজুরি নিয়েই যত ঝামেলা। এটা বিস্ময়কর যে, মিল বন্ধ হয়ে গেলেও পাট নিয়ে সব অধিদপ্তর আর হাজার হাজার কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার কোনো সংকট নেই! সে কারণে তাদের কোনো ক্ষোভও নেই। যত সমস্যা শ্রমিকদের বেতন দিতে। এর থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়- বিজেএমসি এবং সরকারের কাছে এই শ্রমিকরা মূল্যহীন বোঝা।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাটকল শ্রমিকদের দুর্দশা এবং মানবেতর জীবন-যাপনের কথা উঠে এসেছে। প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক কামাল হোসেন দেশকালকে বলেন, ‘গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার পাটকলে ছুটি ঘোষণা করে। ১৪ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। এ অবস্থায় হাতে কোনো টাকা নেই। মুদি দোকানে ১৩ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। এখন আর দোকানি বাকিতে চাল-ডাল দিচ্ছেন না। তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে অভুক্ত থাকার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।’
একই মিলের শ্রমিক নেছারউদ্দিন খান বলেন, ‘মিল বন্ধ, বকেয়া মজুরিও দিচ্ছে না। সে কারণে ভোটার আইডি কার্ড সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছি, কেউ ত্রাণ দিতে আসে কি-না তা দেখার জন্য।’ বদলি শ্রমিক মাসুদ শেখের নালিশ, ‘আগে প্লাটিনাম জুট মিলে বদলি শ্রমিকদের কাজ করতাম। মিল চালু থাকলে দৈনিকভিত্তিতে মজুরি পেতাম; কিন্তু মিল বন্ধ, তাই আয়ও বন্ধ। অথচ খরচ থেমে নেই। মা-বাবা ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। কীভাবে চলব বুঝতে পারছি না। এখনো কোনো সহায়তাও পাইনি।’ স্টার জুট মিলের শ্রমিক হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘আমরা ত্রাণ পাচ্ছি না আবার বকেয়া মজুরিও পাচ্ছি না। এখন ত্রাণ নয়, বকেয়া মজুরি দিলে আমাদের আর সংসারে অভাব হতো না।’
মিল বন্ধ থাকায় বদলি শ্রমিকদের দুর্দশার অন্ত নেই। আর স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন নেই। তাছাড়া ত্রাণও পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ওয়ার্ড প্রতি কিছু ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কিছু শ্রমিক ত্রাণ পেয়েছেন। অন্যদিকে প্রতি সপ্তাহে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা মজুরি। তা দিয়ে তিন-চার দিন চলে। এ অবস্থায় ১৪ সপ্তাহে ১০০ কোটি টাকা মজুরি বকেয়া। শ্রমিকরা এখন না খেয়ে দিন পার করছে। করোনাভাইরাসের চেয়ে এখন শ্রমিকদের মধ্যে না খেয়ে অভাব-অনটনে কষ্ট করে দিন পার করার ভয়ই বেশি দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু মুদি দোকান খোলা থাকলেও তারা পাটকল শ্রমিকদের আর বাকিতে জিনিস দিচ্ছে না। বেতন নেই, ত্রাণ নেই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh