ব্যবস্থাপনার ঘাটতি নিয়েও এগিয়েছে পোশাক শিল্প

‘মেড ইন বাংলদেশ’ খচিত পোশাক এখন গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ষাটের দশকের শুরুতে পুরান ঢাকার একটি দর্জি কারখানা থেকে পথচলা শুরু করা দেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন ‘বিশ্বের বিস্ময়’।

পরবর্তীতে আশির দশকের গোড়ার দিকে মাত্র ১২ হাজার ডলার আয় দিয়ে একটি অপ্রচলিত রফতানি খাত হিসেবে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান বাংলাদেশের। এখন বছরে রফতানি হয় প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের (২ লাখ ৯০ হাজার কোটি) পোশাক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই পোশাক শিল্পই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুনভাবে। রফতানি আয়ের পাশাপাশি পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেখেছে অনবদ্য অবদান। দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ অর্জিত হয় তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। বর্তমানে দেশের রফতানিমুখী ৯ হাজার ৪৬৪টি পোশাক কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক। 

এ দিকে শ্রমিকদের জন্য শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে দেশে ‘গ্রিন গার্মেন্টস’ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু হয়েছে দেশে। পরিবেশবান্ধব করা হচ্ছে সব পোশাক কারখানা। ইতিমধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের কয়েকটি কারখানা। বিশ্বমানের কারখানা ও কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ভালো করায় বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে পোশাক রফতানিতে প্রথম স্থানে থাকা চীনকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখল করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরুর গল্প : পৃথিবীর প্রথম পোশাক তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৮৩১ সালে। আর বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্টস শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। এর শিল্পের স্বপ্নদ্রষ্টার নাম রিয়াজ উদ্দিন। পারিবারিকভাবেই তিনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। ওই সময় করাচি থেকে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এনে তিনি দেশে বিক্রি করতেন। করাচি ভ্রমণকালে একটি গার্মেন্টসকে মাসে ১ লাখ পিস পোশাক রফতানি করতে দেখে বাংলাদেশ থেকেও পোশাক রফতানির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। তার দুই বছর পর ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার উর্দু রোডে তিনি ও তার ভাতিজা মাইজুদ্দিন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন রিয়াজ স্টোর নামে একটি ক্ষুদ্র দর্জি কারখানা। তারা দেশীয় বাজারে পুরুষের শার্ট, নারীদের লেগিংস, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রি শুরু করেন। ওই সময় একটি রিয়াজ শার্টের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১০০ টাকা; যা সমাজের সবচেয়ে ধনী শ্রেণির লোকেরাই পরতেন। সারাদিন আটটি সেলাই মেশিন চলত অর্ডার পাওয়া কাপড় বানানোর কাজে। 

১৯৬৯ সালে ২৭ অক্টোবর অ্যাপোলো-১১ এর সেই তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন কিন্তু তাদের ওয়ার্ল্ড গুডউইল ট্যুরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তারা নেমেছিলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এই তিন নভোচারীর জন্য আয়োজন করা হয়েছিল এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। শত শত মানুষের উল্লাস ও চিৎকারের ভিড়ের মধ্যে সেদিন রিয়াজ উদ্দিন নিজের দোকানে বানানো তিনটি শার্ট নিয়ে গিয়েছিলেন তিন নভোচারীকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেদিন রিয়াজ উদ্দিনের উপহার তারা গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনজনের কাছ থেকে ধন্যবাদ ও প্রশংসামিশ্রিত একটি চিঠিও পান রিয়াজ উদ্দিন। সেই বিশেষ দিনে বাকি সবাই যখন চাঁদে পা রাখা তিনজন নভোচারীকে প্রত্যক্ষ করার খুশি বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন রিয়াজ উদ্দিনের মনে ছিল অন্য চিন্তা। রিয়াজ উদ্দিন স্বপ্ন দেখছিলেন নিজের ব্যবসাকে বৈদেশিক বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার। তিনি ভাবছিলেন, যদি এই তিন আমেরিকান নভোচারী তার বানানো শার্টের প্রশংসা করতে পারেন, তাহলে তা হয়তো অন্য পশ্চিমা নাগরিকদের কাছেও সমাদৃত হবে।

কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার পরিকল্পনাকে থামিয়ে দেয়। তখন উর্দু রোডের অন্যসব দোকান-পাটের সঙ্গে সঙ্গে রিয়াজ উদ্দিনের দোকানটিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর রিয়াজ উদ্দিন নতুন করে তার ব্যবসা শুরু করেন, ১৯৭৩ এ তিনি এর নাম দেন রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড এবং স্বাধীন বাংলার প্রথম তৈরি পোশাক কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

রিয়াজ উদ্দিনের পোশাক রফতানির সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই। ওই দিন তার ১০ হাজার পিস ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে রফতানি করেন। শার্টের ওই চালানের ফরাসি মুদ্রায় দাম ছিল ১৩ মিলিয়ন ফ্রা, বাংলাদেশি টাকায় যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা।

ওই একই বছর রফতানির বিপুল সম্ভাবনা দেখে শিল্পপতি নুরুল কাদের খান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ো কোম্পানির সঙ্গে মিলে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত করলেন দেশ গার্মেন্টস, যা ছিল দেশের প্রথম শভাতগ রফতানিমুখী পোশাক কারখানা। অল্প সময়ের ব্যবধানে এ শিল্প খাতের যাত্রায় যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করে প্যারিস গার্মেন্টস, জুয়েল গার্মেন্টস ও বৈশাখী গার্মেন্টস।

গার্মেন্টস শিল্পের বর্তমান অবস্থা : বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রধান রফতানিমুখী বস্ত্র খাতের তিনটি উপখাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- তৈরি পোশাক, নিট শিল্প এবং স্পিনিং শিল্প খাত। বর্তমান এই তিন খাতে মোট কারখানার সংখ্যা ৯,৪৬৪টি। দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানার সংখ্যা ৫,৪৫০টি, নিট শিল্পের সংখ্যা ১,৮২১, স্পিনিং মিল ৩৮৫, টেক্সটাইল উইভিং শিল্প ৭২১, উইভিং মিল ৫৮৪, ডেনিম মিল ২০, হোম টেক্সটাইল ১৭, নিট কাপড় তৈরির মিল ২৩৩ এবং ডাইং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং মিল রয়েছে ২৩৩টি। এসব কারখানা বিনিয়োগ বোর্ড, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি কর্তৃক নিবন্ধিত এবং স্ব স্ব অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যও; কিন্তু এর বাইরেও প্রায় আরও ২ হাজার কারখানা রয়েছে যারা বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র সদস্য নয়। 

জানা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্পে সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাত করার উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। তাছাড়া পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং ও ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের নতুন কর্মসংস্থান মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের সৃষ্টি, যার সুবিধাভোগী আরও প্রায় ২ লাখ শ্রমজীবী মানুষ। 

পোশাক রফতানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রফতানি আয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪.২৯ শতাংশ। এ সময় রফতানি আয় হয়েছে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ইউএস ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩.২৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে একক মাস হিসেবে সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রফতানি আয় আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৩১.২৫ শতাংশ বেড়েছে। 

ইপিবির হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাকের রফতানি আয় ও প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দুই-ই বেড়েছে। এক হাজার ৪১১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৮৫ কোটি ৬২ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২.৯৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এই খাতে রফতানি ছিল এক হাজার ২৮৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে নিট পণ্যের (সোয়েটার, টি-শার্ট জাতীয় পোশাক) রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৮৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৮৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২৫.৯১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ৭১৩ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

আলোচ্য সময়ে ওভেন পণ্যের (শার্ট, প্যান্ট জাতীয় পোশাক) রফতানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯.৩২ শতাংশ। ৬২৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ওভেন পণ্য রফতানি হয়েছে ৬৮৭ কোটি ডলারের। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।

গার্মেন্টস শিল্পকে নিয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন : রূপকল্প-২১ এর মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এর মধ্যে পোশাক রফতানি থেকেই ৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, সেটি পূরণ হয়নি। করোনাভাইরাসের আঘাতে অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্ত নয় এই শিল্প খাতটিও। এ কারণে উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনার বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী ১০ বছরের জন্য একটি রোডম্যাপ করা দরকার। পাশাপাশি তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে ইতিবাচক প্রচার করতে হবে, সেই প্রচার আসতে হবে এ খাতের বাইরে থেকে। একইসঙ্গে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোকে ইতিবাচক প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার হচ্ছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারের। প্রতি বছর চীনে আমাদের রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে, চীনে ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। তাই দেশের সামনে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগ নিতে অবকাঠামোগত সক্ষমতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। 

অর্থনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে তৈরি পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো এখন সবার সামনে পরিষ্কার। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে, তখন শুল্কমুক্ত পোশাক রফতানির সুবিধা পাওয়া যাবে না। তখন তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হবে। কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি পরিবেশসহ ২৭টি ক্যাটাগরিতে ফ্যাক্টরিগুলোকে নির্দিষ্ট মানোত্তীর্ণ হতে হবে। এ অবস্থায় আগামী দিনের বড় কাজ হবে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //