অস্থিরতা মুদ্রণ শিল্পে

লাফিয়ে বাড়ছে কাগজের দাম

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি লাফিয়ে বাড়ছে কাগজের দাম। কয়েকদিন আগে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বাড়লেও এখন বাড়ছে দিনের ব্যবধানে। খুচরা বাজারে বাড়ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। কাগজের এমন লাগামছাড়া দামে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের কাগজনির্ভর ক্ষুদ্র শিল্প।

বন্ধ হচ্ছে কারখানা। আবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ সংকটে তৈরি হচ্ছে সিন্ডিকেট। এসংকটের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী মুদ্রণ শিল্প ও সংবাদপত্র। প্রভাব পড়ছে বইয়ের ব্যবসায়ও। ফলে দাম বাড়ছে বইয়ের, যার মাসুল গুনতে হবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। ঝরে পড়ার শঙ্কায় লাখো শিক্ষার্থী। মুখ থুবড়ে পড়তে পারে ছাপাখানা ব্যবসাও। ইতোমধ্যে ব্যয় সংকোচনের উপায় খুঁজছে সংবাদপত্র মালিকরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে গভীর সংকটে পড়তে পারে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভটি। খুচরা ব্যবসায়ী, মিল মালিক, ডিলার, ছাপাখানা, শিক্ষাবিদ ও সংবাদপত্রের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এমন অচলাবস্থার কথা।

নিউজপ্রিন্টের বাজার মূল্যের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুনে মধ্য মানের প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ৪৩ হাজার টাকা। গত ডিসেম্বরে তা  বেড়ে হয় ৫১ হাজার টাকা। আর ডিসেম্বরের পর নিউজপ্রিন্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। তিন মাসের ব্যবধানে মার্চে এসে প্রতি টন নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে হয় ৫৬ হাজার টাকা। এর পর নিউজপ্রিন্টের মূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটতে থাকে। এপ্রিলেই আগের মাসের চেয়ে প্রতি টনে ১০ হাজার টাকা বেড়ে হয় ৬৬ হাজার টাকা,  মে মাসেও একই দাম থাকে; কিন্তু চলতি ১১ জুনে টনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৬ হাজার টাকা থেকে ৯৬ হাজার টাকা। নিউজপ্রিন্টের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শতভাগের ওপরে। আর জুনের ১১ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৩ শতাংশেরও ওপরে।

এছাড়া বই, প্যাকেটিং ও আর্ট পেপারের দামও বেড়েছে সমানতালে। সাদা কাগজের দাম চলতি মাসের শুরুতে ছিল এক হাজার ৪৫০ টাকা রিম, তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৭০০ টাকা। আর যে ৩০০ গ্রাম কাভার বোর্ড গেøাসি পেপারের প্রতি শিটের দাম ছিল ১৮ টাকা, মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫-৩০ টাকা। বছরের শুরুতে দাম আরো কম ছিল। তখন একই ধরনের গেøাসি বোর্ড শিট বিক্রি হতো ১২  থেকে ১৫ টাকায়।  কাগজ ছিল এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকার মধ্যে। একই সাথে ছাপার খরচও বেড়েছে। ডিলার পর্যায়ে অফসেট পেপার সিট কেজিতে ১৫ টাকা বেড়েছে। এক মাস আগে প্রতি কেজি ৮৫ টাকায় কেনা গেলেও এখন দাম ১০০ টাকার বেশি। রাইটিং পেপার কেজিতে  বেড়েছে ১০ টাকা। বিদেশি আর্ট পেপার কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যা রিমপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা বেড়েছে।

"পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে গভীর সংকটে পড়তে পারে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভটি"

মিল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও বাড়ছে কাগজের দাম। দেশে তৈরি কাগজের প্রায় সব ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। জ্বালানি  তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। কেমিক্যালের দামও বেড়েছে। নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দাম বাড়ার কারণে কমেছে এলসির পরিমাণ। এতে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দামে এর প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি বিদেশি কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশি কাগজের চাহিদা বেড়েছে। ফলে উত্তাপ ছড়িয়েছে কাগজের বাজারে।

দেশি-বিদেশি কাগজের ডিলার ও করতোয়া পেপার্স ডিপোর মালিক কে এম  রেজা বলেন, দেশীয় কাগজ মূলত তৈরি হয় ওয়েস্ট পেপার থেকে। করোনার কারণে দীর্ঘ দিন কারখানা বন্ধ থাকায় দেশে ওয়েস্ট পেপারের সংকট তৈরি হয়েছে। যে ওয়েস্ট  পেপার আগে ১৫ টাকায় কেনা যেত, তা এখন ৪০ টাকা। রিসাইকেল করে পেপার তৈরি হয়, এখনতো সাইকেলই হচ্ছে না; সংকট তো হবেই।

তিনি আরো বলেন, দাম বাড়ার কারণে এখন এলসি বন্ধ। বিদেশি কাগজ আমদানি খরচ পড়ে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা। ৫ শতাংশ ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্সসহ (এআইটি) সর্বমোট আমদানি শুল্ক ৩২ শতাংশ। পরিস্থিতি  মোকাবিলায় শুল্ক প্রত্যাহার করলে বিদেশি কাগজের দাম ৭০ টাকায়  নেমে আসবে। ফলে চাহিদা কমে যাওয়ায় দেশি কাগজ আবার আগের দামে চলে আসবে। এভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের ছাপাখানা মালিক মোতাছিম বিল্লাহ বলেন, ‘কাগজ ও কালির দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্ডার নেওয়া মাল ডেলিভারি দিতে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হওয়ায় স্টকে কাগজ নেই; তাই বেশি দামে নতুন অর্ডার নেওয়াও সম্ভব নয়। যাদের স্টক আছে তারাই নতুন অর্ডার নিতে পারছে। করোনায় বড় লোকসান কাটিয়ে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চলছে, তখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসতে হবে।

পাশাপাশি কাগজের দামের কারণে বই ও খাতার দাম বাড়লে শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন শিক্ষাবিদরা। নিউজপ্রিন্টের দাম আরো কী পরিমাণ বাড়বে তার কোনো সদুত্তর নেই মিলারদের কাছে।

এদিকে নিউজপ্রিন্টর দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে সংবাদপত্র শিল্পের অন্যান্য উপকরণ যেমন- কালি, প্লেট ইত্যাদির দাম বেড়েছে। এর ফলে সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এব্যয় বেশিরভাগ পত্রিকায়ই বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে।

 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //