চীন ছাড়ছে জাপানের পোশাক ব্যবসায়ীরা, বাজার ধরার হাতছানি বাংলাদেশের!

শ্রমের ব্যয় বৃদ্ধি ও শূন্য-কোভিড নীতির কারণে চীন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছে জাপানের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা।

নিক্কেই এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোও বলছে, ইয়েনের অবমূল্যায়ন ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ কমাতে রীতিমত যুদ্ধ করছে।

এ কারণে অ্যাডাস্ট্রিয়া, আয়োমা ট্রেডিং ও ইউনিক্লো এর মতো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় সরিয়ে নিচ্ছে।

বৈশ্বিক এই প্রতিষ্ঠান অ্যাডাস্ট্রিয়া এ বছর কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে উৎপাদন বাড়িয়েছে।

এছাড়া তারা ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছে।

জাপানে আমদানি করা প্রতিষ্ঠানের পোশাকের মধ্যে চীনে উত্পাদিত পণ্যের সংখ্যা ২০২১ সালে ৫৯ শতাংশ এ নেমে এসেছে। গত এক দশকে এটি ৮১ শতাংশ ছিল।

ইউনিক্লোর সাবসিডিয়ারি ফাস্ট রিটেইলিংয়ের জন্য চুক্তি ভিত্তিক কারখানা পরিচালনা করে মাতসুওকা কর্পোরেশন। ২০২২ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে চীনে এই প্রতিষ্ঠানটি ৫০ শতাংশ পণ্য উৎপাদন করেছিল। কিন্তু ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে তারা ২৯ শতাংশ উৎপাদন কমিয়ে আনতে চায়।

একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ১৬ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি করবে।

প্রতিষ্ঠানটি দুই দেশে উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়াচ্ছে।

কাঁচামাল ছাড়াও শ্রম খরচ সবচেয়ে বড় উৎপাদন খরচ।

জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) অনুসারে, চীনের গুয়াংজুতে একজন কারখানার শ্রমিকের গড় মাসিক বেতন সম্প্রতি প্রায় ৬৭০ ডলারেপৌঁছেছে। যা ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে আনুমানিক ২৭০ ডলার ও বাংলাদেশের ঢাকায় ১২০ ডলার।

এছাড়াও কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া রোধে ব্যাপক লকডাউন শুরু করার চীনের শূন্য-কোভিড নীতি দেশটির উত্পাদন ও সরবরাহের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।

জাপানের পোশাক নির্মাতারা চীনে উৎপাদন কেন্দ্রীভূত করার ঝুঁকি তুলে ধরে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেছে।

বাংলাদেশ কীভাবে এর সুবিধা নিতে পারে

বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকদের মতে, তারা তাদের নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য রপ্তানি বাজার চিহ্নিত করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাপান, কোরিয়া, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা।

তাদের মধ্যে জাপান হল অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাজার। যেখান থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.০৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি আয় অর্জন করেছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের মধ্যে এটি দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

ফাস্ট রিটেইলিং (ইউনিক্লো ও অন্যান্য পাঁচটি খুচরা বিক্রেতার মূল কোম্পানি), অ্যাডাস্ট্রিয়া, জিইউ, মুজিসহ বেশ কয়েকটি জাপানি পোশাক খুচরা বিক্রেতা প্রায় ৩০০-৩৫০টি বাংলাদেশি কারখানা থেকে লক্ষ লক্ষ পণ্য সংগ্রহ করে। এরমধ্যে রয়েছে প্যাসিফিক জিন্স, ঊর্মি গ্রুপ, এনভয় টেক্সটাইলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের নাম।

প্যাসিফিক জিন্স হল ইউনিক্লোর অন্যতম শীর্ষ সহযোগী প্রতিষ্ঠান। যারা পূর্ব এশিয়ার গন্তব্যে মিলিয়ন পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে।

এছাড়াও এনভয় টেক্সটাইল ইউনিক্লোরও সরবরাহকারী।

এর প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাপানি ক্রেতারা মানের ব্যাপারে খুবই সতর্ক।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘চীন থেকে জাপান তাদের উৎপাদন স্থানান্তর করছে। এটি আমাদের জন্য খুবই ভালো খবর।’

‘তবে জাপানে উচ্চ-মূল্যের পণ্যের চাহিদা বেশি। জাপানের বাজার ধরার জন্য আমাদের মূল্য সংযোজন পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে,’ তিনি যোগ করেন।

তিনি আরো বলেন, ‘তারা যদি এটি করতে পারে তবে ২০৩০ সাল থেকে জাপানে দেশটির রপ্তানি প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।’

শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘চীন ধীরে ধীরে টেক্সটাইল খাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এই খাতটি ধীরে ধীরে চীনে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ সেখানে শ্রমের দাম বেশ বেশি।’

ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেলও একই ধরনের অনুভূতির জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘জাপান বাংলাদেশের জন্য উচ্চ সম্ভাবনার একটি বাজার।’

তিনি আরো বলেন, ‘ইউনিক্লো ও অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে একটি বড় সংখ্যার পণ্য নিয়ে থাকে। আমরা জাপানের বাজারে আরো বেশি অংশ দখল করতে চাই। আমাদের সক্ষমতা রয়েছে।’

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘তাদের এফওবির মান খুব ভালো ও তাদের লেনদেন ক্ষমতা ভালো।’

‘তবে এক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি), শিপমেন্টের সময় বজায় রাখা ও জাপানের দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্যাশন ট্রেন্ড ধরাসহ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাজার দখল করতে, আমাদের অবশ্যই উচ্চ-মূল্যের পণ্যে নজর দিতে হবে।’

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে জাপানের পোশাক আমদানি ২৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার ছিল। যেখানে চীনের অংশ ছিল ৫৮.৩২ শতাংশ, এরপরে ভিয়েতনাম (১৪.৪৯ শতাংশ) ও বাংলাদেশের ৪.৮৯ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ জাপানে ১.০৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর), বাংলাদেশ জাপান থেকে ৫৪৫.৪২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //