বদর যুদ্ধে জয় ছিল মুসলিম উম্মাহর প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি

আজ ১৭ রমজান। ঐতিহাসিক বদর দিবস। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। হিজরি দ্বিতীয় সনে ১৭ রমজান মদিনার অদূরে ৮০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে বদর নামক স্থানে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়। 

কোরআনুল করিমে এই যুদ্ধের বিবরণ ও বিশেষত্ব সম্পর্কে বহু আয়াতে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিশেষভাবে কিছু আয়াত হলো, ‘দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এক দল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছিল, অন্য দল কাফির ছিল, তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে। (আল ইমরান, আয়াত ১৩)।’

‘আর বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে আল্লাহ তো তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। স্মরণ কর, যখন তুমি মুমিনগণকে বলছিলে, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদেরকে সহায়তা করবেন? হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। এটা তো কেবল তোমাদের জন্য সুসংবাদ ও তোমাদের চিত্ত-প্রশান্তি  হেতু আল্লাহ করেছেন। এবং সাহায্য শুধু পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট থেকে হয়। (আল ইমরান :১২৩-১২৬)।’ 

মুসলিমদের হাতে বন্দি শক্র সৈন্যরা পরবর্তীকালে সাক্ষ্য দেয় যে, যুদ্ধের সময় তারা মুসলিম বাহিনীকে দ্বিগুণ অবস্থায় দেখে। মহানবী (সা.)-এর সমর কৌশলে ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাহায্যে তা সম্ভবপর হয়েছিল। যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,‘...আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক সহস্র ফেরেশতা দ্বারা যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ তা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেয়ার জন্য ও এ উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে এবং সাহায্য তো শুধু আল্লাহর নিকট হতেই আসে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (আনফাল: ৯-১০)। 

‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কাফির বাহিনীর সন্মুখীন হবে তখন তোমরা তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না; সেদিন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন কিংবা দলে স্থান লওয়া ব্যতীত কেহ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর বিরাগ-ভাজন হবে এবং তার আশ্রয় জাহান্নাম, আর উহা কত নিকৃষ্ট! তোমরা তাদেরকে বধ কর নাই, আল্লাহই তাদেরকে বধ করেছেন এবং তুমি যখন নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ কর নাই, আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন এবং ইহা মুমিনগণকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করবার জন্য; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। এটাই তোমাদের জন্য, আল্লাহ কাফিরদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন।’ (আনফাল: ১৫-১৮)

ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বদর যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন। 

মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের বাতাস মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলিমদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলিমরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলিমদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলিমরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলিমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য ওহি লাভ, মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন ও রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

বদর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর রাসুল (সা.) পানির উৎস হিসেবে বদরের কূপের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে গেলেন ও মধ্যরাতে কূপের কাছে পৌঁছে তাঁবু ফেললেন। সাহাবারা সেখানে হাউস বানালেন ও বাকি সব জলাশয় বন্ধ করে দিলেন। এরপর রাসুল (সা.) সেনাবিন্যাস করেন। উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হলো। এ সময় রাসুল (সা.) হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বললেন, ‘হে আল্লাহ, কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহংকারের সাথে তোমার বিরোধিতায় ও তোমার রাসুলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ, আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্যের বড় বেশি প্রয়োজন। আল্লাহ তুমি আজ ওদের ছিন্নভিন্ন করে দাও।’

রাসুল (সা.) এ সময় মুসলিম বাহিনীকে কাতারবন্দি করলেন। কাতার সোজা করার পর নবী (সা.) সাহাবিদের বললেন, তাঁর পক্ষ থেকে নির্দেশ না পেয়ে কেউ যেন যুদ্ধ শুরু না করে। তিনি সাহাবিদের সামনে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনা তুলে ধরলেন এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন। 

তিনি বললেন, পৌত্তলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করবে। তীরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। তারা তোমাদের ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালাবে না। এরপর নবী (সা.)  আবু বকর (রা.)- কে সাথে নিয়ে অবস্থান কেন্দ্রে চলে গেলেন।

যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন ছিল আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি। সে ময়দানে বের হওয়ার সময় বলছিল, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করছি যে ওদের হাউসের পানি পান করেই ছাড়ব। যদি তা না পারি, তবে সেই হাউসকে ধ্বংস বা তার জন্য জীবন দেব। অন্যদিকে সাহাবিদের মধ্য থেকে হামজা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এগিয়ে যান ও আসওয়াদকে হত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে তিনজন বিশিষ্ট যোদ্ধা বেরিয়ে এলো। তারা হলো রাবিয়ার দুই পুত্র ওতবা ও শায়বা এবং ওতবার পুত্র ওয়ালিদ। তাদের মোকাবেলায় আউফ, মুয়াউয়িজ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। কুরাইশরা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের পরিচয় কী? তারা বলল, আমরা মদিনার আনসার। কুরাইশরা বলল, তোমরা অভিজাত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমাদের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা স্ববংশীয় অর্থাৎ কুরাইশদের োথে লড়াই করতে চাই। তখন রাসুল (সা.) ওবায়দা ইবনে হারেস, হামজা ও আলী (রা.)- কে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা তিনজনই নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। হারেস (রা.) ওতবার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন। এভাবেই সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিম বাহিনীর ব্যর্থতা ও হতাশার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুসলিমদের প্রবল আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। যুদ্ধের পরিণাম হয়ে উঠল সুস্পষ্ট। অন্যদিকে রাসুল (সা.) মুসলিম বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করলেন ও তাদের সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদও দিলেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে ফেরেশতা প্রেরণ করলেন। আল্লাহর সাহায্য ও মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের কাছে দাম্ভিক কুরাইশদের করুণ পতন হলো।

মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামী রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রাসুল (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণে সৎসাহস খুঁজে পায়। 

বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য ও আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল। যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে রাসুল (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সাথে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই ও আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহ তাআলা তাদের হিদায়াত দেবেন ও তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

রাসুল (সা.) আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। রাসুল (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আযাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। (তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬)

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেয়া হয়। যেমন, মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই ও লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা বদর যুদ্ধের ও অসংখ্য হাদিস দ্বারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রণকারীদের মর্যাদা প্রমাণিত। রাফায়া ইবনে রাফে তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। জিবরাঈল (আ.) নবী (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাস করেন, আপনারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কিভাবে মূল্যায়ন করেন? রাসুল (সা.) বলেন, সর্বোত্তম মুসলিম হিসেবে অথবা অনুরূপ কিছু। জিবরাঈল (আ.) বলেন, অনুরূপ ফেরেশতাদের মধ্যেও যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। (বুখারি,  : ৩৭৭১)

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, অপর হাদিসে রাসুলে আকরাম (সা.) বদর যুদ্ধে শহীদ একজন সাহাবিকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন।

আবু হুরায়রা (রা.) হাদিসে মহানবী (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমার সুসংবাদ দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে অবগত আছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছা করো। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘এমন মহান সুসংবাদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া আর কেউ পায়নি।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা ৩০৫)

একইভাবে রাসুল (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছেন। জাবের (রা.) বর্ণিত, হযরত হাতেব (রা.)-এর একজন দাস রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তার বিরুদ্ধে নালিশ করল এবং সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), নিশ্চয় হাতেব জাহান্নামে যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে যাবে না। কেননা সে বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল।’ (মুসলিম : ২৪৯৫)।

বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এই অপরিমেয় সম্মান ও মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এটা নিছক কোনো যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এর প্রকৃত রূপ ছিল অকল্পনীয় রকম কঠিন ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এজন্য রাসুল(সা.) তাদের মর্যাদাপূর্ণ জান্নাত ফেরদৌসের উচ্চ স্তরের লাভের ঘোষণা দিয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা ২৫৮)

বদরের যুদ্ধের কিছু সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হলো-

মুসলিম বাহিনী

সৈন্য সংখ্যা: ৩১৩জন। মুহাজির ছিলেন ৮২ জন। আর সবাই আনসার। আওস গোত্রের ৬১ জন এবং খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন।

মুসলিম সেনাপতি: বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

মুসলিমদের উট ও ঘোড়ার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে: ৭০টি ও ২টি।

 মুসলিম বাহিনী শহীদ হয়: ১৪ জন।

বদর যুদ্ধে কান্নাকাটি করে অংশগ্রহণের অনুমতি লাভকারী হলেন: হওমায়ের বিন ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু।

কুরাইশ বাহিনী

অমুসলিম সৈন্য সংখ্যা ১০০০ জন।

কুরাইশ বাহিনীর ছিল অসংখ্য উট, ১০০টি ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম। কুরাইশ বাহিনীর জন্য প্রতিদিন ৯-১০টি উট খাওয়ার জন্য জবাই করা হতো।

অমুসলিম সেনাপতি: ওতবা বিন রবীআ।

অমুসলিম নিহত ৭০ জন ও বন্দিও হয় ৭০ জন।

বদর যুদ্ধে কুরাইশদের প্রায় গোত্র অংশগ্রহণ করলেও বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //