লিবিয়ায় গিয়ে যেভাবে দাসের জীবনে বাংলাদেশিরা

ভালো রোজগার আর একটু ভালো থাকার আশায় অনেক বাংলাদেশি তরুণ লিবিয়া হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের একটি অংশের সলিল সমাধি ঘটছে ভূমধ্যসাগরে। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি। 

এছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আছেন আটক অবস্থায়। লিবিয়ায় থাকা এমন বাংলাদেশিদের দুর্দশা নিয়ে বিবিসি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 

আফ্রিকার সাংবাদিকদের কাছ থেকে বেশ কিছু চিঠি পাওয়ার পর বিবিসির ইসমাইল এইনাশে বাংলাদেশি এক তরুণের সঙ্গে দেখা করেন। কীভাবে তিনি প্রতারিত হওয়ার পর লিবিয়ায় গিয়ে কাজ করেছেন এবং কীভাবে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন— ওই তরুণ তার সেই অভিজ্ঞতার কথাই ইসমাইলকে শোনান।

ওই তরুণ এখন আছেন ইতালির পলিমারোতে। সেখানেই ইসমাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার এবং লিবিয়ায় তার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা শোনান তিনি।

ধরা যাক ওই তরুণের নাম আলী। তার ঝুঁকিপূর্ণ জীবনকে আরও ঝুঁকিতে না ফেলতে তার আসল নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

 ২০১৯ সালে তার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন তিনি মা-বাবার আশীর্বাদ নিয়ে কাজের খোঁজে লিবিয়ায় উদ্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রা শুরু করেন।

এক দালালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই আলী এ ব্যাপারে উৎসাহী হন। প্রকৃতপক্ষে এ দালালেরা হলেন মানবপাচারকারী। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ফাঁদ পেতে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ বাংলাদেশিদের আকৃষ্ট করে থাকেন তারা। ধনী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই মূলত তরুণদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করা হয়।

আলীর সঙ্গে যে দালালের পরিচয় হয়েছিল, সে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়মিত লিবিয়া যাওয়ার প্ররোচণা দিত। এমনকি তাকে বাড়িতে রাতের বেলা দাওয়াত করেও খাওয়াত। দেশে থাকার সময় ঢাকার কাছে একটি শহতলীতে কয়েক বছর একটি প্রসাধনীর দোকানে  কাজ করে পদ্মা পাড়ের একটি গ্রামে নিজ পরিবারকে সহায়তা করার চেষ্টা করতেন এই তরুণ।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলীর মতে এমন সুবিধাবঞ্চিত যারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দালালরা তাদের সেই স্বপ্নকেই পুঁজি করে। লিবিয়ার উদ্দেশে যারা পাড়ি জমান, তাদের মধ্যে খুব কমই গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত এই দেশটি সম্পর্কে জানেন। যারা সেখানে পাচার হয়ে যান, তারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বন্দি হন দাসত্বের শৃঙ্খলে।

আলী বলেন, লিবিয়া সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।

দালালরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, লিবিয়ার কারখানায় কাজ করে তাদের ছেলে মাসে ৫০০ ডলার আয় করতে পারবে। পরে অবশ্য তার মা-বাবার সঙ্গে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আলীর মা-বাবা দালালদের বলেছিল, লিবিয়া যাওয়ার খরচ তারা যোগাতে পারবেন না। কিন্তু তাদের তিনটি বড় আকারের গরু দেখে দালালরা সেখান থেকে একটি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করার বুদ্ধি দেয়।

ঢাকা থেকে বাসে যাত্রা শুরু করে ভারতের কলকাতায় পৌঁছানোর পর উড়োজাহাজে কয়েক দফায় মুম্বাই, দুবাই ও কায়রো হয়ে লিবিয়া পৌঁছাতে আলীর সময় লেগেছিল এক সপ্তাহ। লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আলীর মনে হয়েছিল নিরাপত্তা আর পুলিশবিহীন বিশৃঙ্খল একটি জায়গা সেটা। দালালের লোকেরা তাকে সেখান থেকে দ্রুত একটি বন্দিশালায় নেওয়ার পর তার কাছে থাকা সব টাকা নিয়ে নেয়। এরপর তাকে মুক্তিপণের জন্য সেখানে আটকে রাখে। তাকে মুক্ত করার জন্য আলীর মা-বাবাকে শেষ গরুটিও বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

আলী বলেন, বন্দিশালায় ছোট একটি কক্ষে সঙ্গে আরও ১৫ জন বাংলাদেশি ছিলেন। যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারত না তাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না ও মারধর করা হতো। তারা আমার সামনে একজনকে পিটিয়েছিল, এক সময় তার রক্তপাত শুরু হয়। তারা ওই ব্যক্তিকে কোনও চিকিৎসা দেয়নি, হাসপাতালেও নেয়নি।

অবশেষে বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আলী বেনগাজিতে পাচারকারীদের একটি পানি বোতলজাত করার কারখানায় কাজ পান। পরে ত্রিপলিতে গিয়ে একটি টালি কারখানায় কাজ করতে হয়। সেখানে কোনও পারিশ্রমিক ছাড়া দুর্বিষহ এক পরিবেশে ছিলেন তিনি। আলীর মতো এমন ২০ হাজার বাংলাদেশি লিবিয়ায় রয়েছেন বলে সম্প্রতি এক হিসাব পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। 

আলী বলেন, কাজ থামালেই আমাদের মারধর করা হতে, লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিত। একবার আমাদের একজন একটা টালি ভেঙে ফেলায় একজন এসে তাকে লাথি মারতে শুরু করে। টালি কারখানার মালিক কিশোর বয়সীদের বাসায় তালা দিয়ে আটকে রাখতেন। মালিক আমাদের কাজে নিয়ে যেতেন এবং কাজ শেষ হলে বাসায় ফিরিয়ে নিতেন। আমাদের নজরদারির জন্য দুইজন পাহারাদার ছিলেন। কাজের জন্য আমাদের কোনও মজুরি দেওয়া হত না এবং পর্যাপ্ত খাবারও পেতাম না। যে কারণে আমরা পালিয়ে যেতে চাইতাম, আমাদের একজন পালানোর চেষ্টা করে তিন তলা থেকে পরে পা ভেঙে ফেলে।

কয়েক দফা পালানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর লিবিয়ার এক ব্যক্তি আলীকে মসজিদে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। তবে তার মনে হয়েছিল, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছাতে তাকে আবারও পাচারকারীদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে। এবার সিদ্ধান্ত নেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাবেন ইতালি।

ছেলের ইতালি যাওয়ার কথা জানার পর আবার আলীর মা-বাবা ছেলের জন্য টাকার ব্যবস্থা করে দেন। আলীর অনুমান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া পর্যন্ত পুরো যাত্রাপথে তার খরচ হবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। এতে করে দীর্ঘদিন ঋণের বোঝা টানতে হবে তাদের।

গত বছরের জুলাই মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ির ঘটনা আলীর ও ডিঙি নৌকায় থাকা অন্য ৭৯ অভিবাসীদের জন্য আরেকটি ভয়ংকর অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়েছিল।

আলী বলেন, পুরো দুইদিন সাগর ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখছিলাম না। হঠাৎ আমাদের কাছেই দুটি হাঙর দেখতে পেলাম। ওই সময় কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন যে হাঙরগুলো আমাদের খেয়ে ফেলার জন্য আসছে। আমি তখন মনে করেছিলাম, এবার বুঝি আমরা শেষ।

ইতালির উপকূলীয় শহর সিসিলিতে স্থানান্তরের আগে ল্যাম্পেডুসা নামের একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় আলীদের। আলী এখন সিসিলির রাজধানী পলিমারোর উপকণ্ঠে একটি বড় অভিবাসী আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে অন্য অনেক দেশের এমন অনেক তরুণ রয়েছেন।

আলী এখন ইতালিতে কাজের অস্থায়ী অনুমতি পেয়েছেন। কিন্তু আশ্রয় চেয়ে করা তার আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন।  

পালেরমোয় বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন আলী। সেখানে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়েছেন। সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করে তিনি মাসে পান ৮৭০ ডলার, যা সিসিলিয়ানদের আয়ের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। ওই আয়ের মধ্যে ৫৭০ ডলার তিনি দেশে বাবা-মাকে পাঠাতে পারেন।

বিবিসি প্রতিবেদনে লিখেছে, লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশিদের অবস্থা গত কয়েক বছরে আরও খারাপ হয়েছে। ২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলির কাছে মিজদাহ শহরে একটি গুদামে ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বাংলাদেশের।

ওই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাদের পরিবার মুক্তিপণের অর্থ দিতে পারেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //