পরিবারের কাছেই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত প্রবাসীরা

প্রবাস মানেই পরবাস বা পরের দেশে বসবাস এই কথাটি প্রবাসে আসার আগে কেউই উপলব্ধি করতে পারেন না। দুচোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে যারা প্রবাসে আসেন, আসার আগে তারা অনেক আনন্দ নিয়েই বিদেশে পাড়ি জমান; মনে করেন বিদেশে পাড়ি দেওয়া মাত্রই তার জীবনের সব সমস্যা দূর হয়ে সব আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। প্রবাসে পাড়ি জমানো ব্যক্তির পরিবারের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে। পরিবারের সদস্যরা ভাবতে শুরু করেন, সুখের প্রহর এই শুরু হলো, এ আর থামবে না। পরিবারের সদস্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বিদেশে পাড়ি ব্যক্তিটি যখন পরিবারের চাহিদা মতো অর্থ দেশে পাঠাতে না পারেন তখনই শুরু হয় অবহেলা।

জীবন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে এসে প্রবাসীরা প্রথমেই হোঁচট খান ভাষাগত কারণে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষা শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখা ছাড়া আর প্রথমবার বিদেশের মাটিতে আসা ব্যক্তিটির আর কোনো উপায় থাকেনা। তারপর কাজ নিয়ে শুরু হয় নতুন বিপত্তি। দেশ থেকে আসার আগে যাদের মাধ্যমে প্রবাসে পাড়ি জমান, তাদের কথা আর কাজে মিল খুঁজে পাননা অনেকেই। বিশেষ করে দালালচক্রের লোভনীয় প্রস্তাবে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশিরভাগ বাংলাদেশিরা। কয়েক লাখ টাকা গচ্চা দেওয়ার পর দেশে ফিরে যাবারও কোনো উপায় থাকেনা অসহায় প্রবাসীদের। সে সময় পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে সবার জন্যই বোঝা হয়ে দাড়ান সেই ব্যক্তিটি।

যদি কোনো বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান তাহলে তাকে ভোর ৫টায় ঘুম কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়। তাকে সারাদিন মরুভূমির দেশে ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি কখনো কখনো ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার প্রচণ্ড গরম সহ্য করে  কাজ করে যেতে হয়। মাস শেষে যথাযথে সময়ে অনেকে বেতনও পান না। রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় বেতনের জন্য অনেককে। দুই থেকে তিন মাসের বেতন রেখে দেয় অনেক কোম্পানি, অনেক কোম্পানি আবার পুরো বেতন না দিয়ে প্রতি মাসে বেতন থেকে কিছু কেটে রেখে দেন। অবশিষ্ট বেতনের টাকা থেকে নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্য যা না রাখলেই নয় সেটা রেখে বেতনের পুরো টাকা দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। 

প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনসহ নিজের জন্মভূমির প্রতি কতটা আবেগপ্রবণ তা প্রবাসী হওয়ার আগে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। নিজের আরাম-আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে প্রবাসীরা আপনজনের মুখে হাসি ফোটান। প্রবাসীদের হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকে শত লাঞ্চনা-বঞ্চনা, পাওয়া-না পাওয়ার করুণ কান্না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের মনের কথা পরিবার-পরিজন জানতে চাননা। তারা সংসারের ঘানিই টেনে যান প্রতিনিয়ত।

প্রবাসীরা নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা বেতন পান এটা পরিবার ও স্বজনেরা অনেক সময় মানতেই চান না। তারা ভাবেন, প্রবাসে থাকা ব্যক্তিটি অগাধ আয় করছেন। সংসার খরচ, ভাইবোনসহ সন্তানের লেখাপড়া, বিভিন্ন জিনিসপত্রের আবদার, ভাইয়ের চাকুরি, বোনের বিয়ে, পারিবারিক ঝামেলা, নতুন ঘরবাড়ি সবকিছু মিলিয়ে টাকার মেশিনে পরিণত হতে হয় প্রত্যেক প্রবাসীকে। তার উপর বিদেশে থাকার সুবাদে বন্ধুবান্ধবের ফরমায়েশি নানান চাওয়াও পূরণ করতে হয়। অনেক সময় কারো চাওয়া পূরণ না হলে সেই প্রবাসীকে মিথ্যাবাদীর অপবাদও সইতে হয়। 

আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পেরে অনেক প্রবাসী কিছু বাড়তি ইনকামের আশায় নির্দিষ্ট কাজের পাশাপাশি পার্ট-টাইম কাজ করে থাকেন। প্রবাসে আসা ব্যক্তিটি যদি বিবাহিত হন তাহলে তার দায়িত্বের চাপ আরো বেশি। নিজের বাবা-মা, শ্বশুরবাড়ির আবদার সবমিলিয়ে সেই ব্যক্তিটিকে গোটা রাজ্যের চাপের মতো চাপ সহ্য করতে হয়। অনেক প্রবাসী এসব চিন্তায় আত্মহত্যার পথে ছুটে যান। গত বছরে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই ১০ বাংলাদেশি আত্মহত্যার করেছেন। এদের প্রায় সবাই পারিবারিক কলহের কারণে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।

অনেক সময় ১৫ থেকে ২০ বছর পর প্রবাসে থাকার পর দেশে ফিরে গেলেও অনেকে নানা লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হন। দেশে পাঠানো টাকার হিসেব নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে কেনা জমিসংক্রান্ত সমস্যা সামনে এসে হাজির হয়।

আরব আমিরাতের কমিউনিটি নেতারা বলেন, বিদেশের মাটিতে প্রবাসীদের আত্মহত্যা ও হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ সত্যি উদ্বেগজনক। এটি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রবাসীদেরকে নিয়ে দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো খুব জরুরি। প্রবাসীর পরিবারের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেনো প্রবাসীদেরকে সম্পূর্ণভাবে চিন্তামুক্ত রাখতে সহায়তা করেন এবং তাদের উপর যেনো কোনো পারিবারিক বা সামাজিক বিষয়ে চাপ প্রয়োগ না করেন। সেক্ষেত্রে প্রবাসীরা দুশ্চিন্তা মুক্ত থেকে কাজে মনোযোগী হতে পারবেন। অন্যথায় সেই ব্যক্তি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়বেন। 

তিনি আরো বলেন, দেশে ফিরে যাওয়ার পর প্রবাসীরা যেনো ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন সেজন্য প্রবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য সরকারের একটি বিশেষ আইন বাস্তবায়িত করা উচিত। তিনি সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ আইন বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //