কোন পথে আলজেরিয়া?

গত ২ নভেম্বর আলজেরিয়ার নির্বাচনী সংস্থা ডিসেম্বরের নির্বাচনের জন্য পাঁচ জন প্রার্থীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে। ফরাসি মিডিয়া ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই পাঁচ জনের মধ্যে দুজন এর আগে এপ্রিল মাসে পদত্যাগ করা প্রেসিডেন্ট আব্দেল আজিজ বুতাফ্লিকার সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৭৫ বছর বয়সী আলী বেনফ্লিস ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর ৭৩ বছর বয়সী আব্দেল মাদিদ তেব্বুনে ২০১৭ সালে মাত্র তিন মাসের জন্যে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এ দুজনই নির্বাচনে জেতার জন্য ফেভারিট। যদিও আন্দোলনকারী জনতা ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে না। তারা বলছেন, বুতাফ্লিকার সময়কার নেতৃবৃন্দ এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন, এবং তারা নিজেদের হাতে ক্ষমতা ধরে রেখেই পরবর্তী নেতা নির্বাচন করবেন। এর আগেই জুলাইয়ের ৪ তারিখে একবার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করা হয়। সে সময় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এবারে এ দুজনের সঙ্গে বাকি তিনজন প্রার্থীও বুতাফ্লিকার সময়ের রাজনীতিবিদ। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আজ্জেদিন মিহুবি, সাবেক পর্যটনমন্ত্রী আব্দেলকাদের বেনগ্রিনা এবং এল-মোস্তাকবাল মুভমেন্ট পার্টির আব্দেলআজিজ বেলাইদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।

বিবিসি জানিয়েছে, আন্দোলনকারীরা এখনো প্রতি শুক্রবার রাস্তায় জড়ো হচ্ছেন এবং তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন মানছেন না। তারা বলছেন, বুতাফ্লিকার সময়ের সব কর্মকর্তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাচন হলে তবেই তারা তা মেনে নেবেন। বিবিসি আরও জানিয়েছে, যদিও এ মুহূর্তে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের স্পিকার আব্দেল কাদের বেনসালাহ হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট, তবে মূল ক্ষমতা রয়েছে জেনারেল আহমেদ গাইদ সালাহর হাতে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বুতাফ্লিকার ভাই সাঈদ বুতাফ্লিকা এবং আরও দুজন ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করার জন্য ১৫ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। এই বিচারকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যেন মনে হয় যে, দুর্নীতি দমনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করার সদিচ্ছা এই সরকারের রয়েছে।

তবে একই সময়ে কেউ কেউ আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা আলোচনায় আনছেন। তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফরাসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার ৬৫ বছর পরেও আলজেরীয়রা ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধগুলো ভুলে যাননি। প্রতি বছরই লুটপাট, অত্যাচার, খুন এবং পারমাণবিক বোমার টেস্টিং গ্রাউন্ড হিসেবে আলজেরিয়াকে ব্যবহার করার জন্য ফ্রান্সকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি ওঠে দেশটিতে। ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছর আলজেরিয়া ফ্রান্সের দখলে ছিল। ২০১৯ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়েও দাবি ওঠে ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক রজ্জু ছিন্ন করার। তারা দাবি তোলেন, আলজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আন্দোলনকারীরা আরও বলছেন, আলজেরিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্য ফ্রান্সই দায়ী। ফরাসিরা মসজিদ এবং ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আলজেরীয়দের পরিচয়ই মুছে ফেলতে চেয়েছিল। ১৮৩৬ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়াতে ক্যাথলিক মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং আইন প্রণয়ন করে ফরাসিদের আলজেরিয়ায় জমি কেনার পথ করে দেয়। ১৮৮০-৮১ সালে ফরাসি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ৩১ জন আলজেরীয় বিদ্রোহীর মাথা কেটে প্যারিসে নিয়ে জাদুঘরের ডিস্প্লেতে রাখা হয়। আলজেরিয়া ২০১১ সাল থেকে ওই বিদ্রোহীদের মাথা ফেরত চাইছে। 

১৯৪৫ সালে নাৎসি জার্মানির পতনের পর আলজেরীয়রা স্বাধীনতার জন্যে দাবি তুলে রাস্তায় নেমে আসলে ফরাসি সরকার জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে প্রায় ৪৫ হাজার আলজেরীয় নিহত হন। ২০১৭ সালে আলজেরিয়ান লীগ ফর দ্য ডিফেন্স অব হিউম্যান রাইটস নামের একটা মানবাধিকার সংগঠন জানায়, ফরাসি উপনিবেশিক অত্যাচারে ১ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে ১৫ লাখ আলজেরীয় নিহত হন। ফরাসি সরকারের হিসাবে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফরাসিরা আলজেরিয়ার মরুভূমিতে ১৭টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল। যদিও আলজেরিয়ার ঐতিহাসিকরা বলছেন, এই সংখ্যাটা ৫৭। পারমাণবিক পরীক্ষার কারণে তেজস্ক্রিয়তায় ৪২ হাজার আলজেরীয় নিহত হন, ব্যাপক ক্ষতি হয় পরিবেশের। ফরাসিরা আলজেরিয়া থেকে বহু বই, মানচিত্র এবং প্রত্নতত্ত্ব নিজেদের দেশে নিয়ে যায়, যা আলজেরীয়রা আজও ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। 

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আব্দেল আজিজ বুতাফ্লিকা ছিলেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন নেতা। তার পূর্বের নেতারাও ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। স্বাধীনতার পর থেকেই আলজেরিয়ার নেতৃত্ব রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (এফএলএন) হাতে। নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে ফ্রান্স-বিরোধিতা জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেওয়ারই একটা লক্ষণ। একইসঙ্গে আলজেরিয়া ইউরোপের বাইরেও বন্ধু খুঁজছে। ৯ অক্টোবর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু আলজেরিয়া সফর করেন। এ সময় দুই দেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করে। আলজেরিয়া সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখে চলেছে। গত ডিসেম্বরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আলজেরিয়া সফর করেন। রাশিয়ার সঙ্গেও আলজেরিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। তেলের বাজারে অস্থিরতার সময়ে আলজেরিয়ার অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে তুরস্ক, সৌদি আরব এবং রাশিয়ার মতো দেশের সমর্থন তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখনো আলজেরিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী হলো ফ্রান্স-সহ ইউরোপ। ইউরোপে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রপ্তানি করে আলজেরিয়া বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে, যেখান থেকে আসে দেশটির সরকারি বাজেটের সিংহভাগ। এই বাস্তবতা থেকে বের হওয়াটা আলজেরিয়ার জন্য কঠিন। অন্যদিকে, ইউরোপের জন্য আলজেরিয়া থেকে আমদানি করা জ্বালানি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অভিবাসন প্রত্যাশীদের ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণেই আটকে দিয়ে ইউরোপের স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রেও আলজেরিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আলজেরিয়ার ডিসেম্বরের নির্বাচন ইতিমধ্যেই সমালোচিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ইউরোপ আলজেরিয়ার ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারবে, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //