গৃহযুদ্ধ থামাতে রাজনীতি ছাড়তেও রাজি ছিলেন গাদ্দাফি

২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাবে লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনগণ। সামরিক কায়দায় এ বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তিনি নিজেকে যেমন জনগণ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, তেমনি দেশকে ঠেলে দেন গৃহযুদ্ধের দিকে। 

এক পর্যায়ে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে। এ সময়ে গাদ্দাফি রাজনৈতিক নির্বাসনের বিনিময়ে হলেও গৃহযুদ্ধ থামাতে রাজি ছিলেন। লিবিয়ায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সেটিই ছিল শেষ প্রচেষ্টা। 

তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর না করতে পারায় গাদ্দাফি যেমন নৃশংস নির্যাতনে নিহত হয়েছেন, তেমনি লিবিয়া আজ পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসযজ্ঞে। 

সম্প্রতি নরওয়ের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোনাস স্টোরের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট লিবিয়ায় ন্যাটোর বোমাবর্ষণ শুরুর দশম বার্ষিকীতে এ তথ্য প্রকাশ করে। 

২০১১ সালে জোনাস স্টোর ছিলেন নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মূলত তার উদ্যোগেই অসলোতে ওই শান্তি আলোচনার আয়োজন করা হয়। জোনাস স্টোর জানান, লিবিয়ায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কয়েক দফা দরকষাকষির পর শান্তি আলোচনায় গতি আসে। ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল অসলোর একটি হোটেলে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় লিবিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্তারা। সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন মোহাম্মদ ইসমাইল, যিনি গাদ্দাফিপুত্র সাইফ আল-ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে পরিচিত। অন্যদিকে, বিদ্রোহী পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন আলি জেইদান। বিদ্রোহীদের ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। 

জোনাস বলেন, ‘আলোচনার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত আবেগাপ্লুত। দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের বক্তব্যেই দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ফুটে ওঠে।’

আলোচনায় উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছিল যে, মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ায় তার ৪২ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটাবেন শান্তিপূর্ণভাবে। লিবিয়ার শাসন ব্যবস্থা একইরকম থাকবে। তবে আলোচনা থমকে পড়ে গাদ্দাফির ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিদ্রোহীদের দাবি ছিল- তাকে বিদেশে চলে যেতে হবে। কারণ, তার উপস্থিতিতে এ ব্যবস্থা আগের মতোই থাকবে, কোনো মৌলিক পরিবর্তন হবে না। এদিকে গাদ্দাফি ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হলেও দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। আর এ নিয়েই দরকষাকষি চলছিল।

তবে আলোচনাটি ভেস্তে যায় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কারণে। জোনাস জানান, দেশ দুটি কোনোভাবেই চাইছিল না- আলোচনার ভিত্তিতে এ সংঘাতের সমাধান আসুক। জোনাস বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম, কূটনৈতিক সমাধানের বিষয়টি লন্ডন ও প্যারিসের চিন্তাতেও ছিল না। তারা কি আদতে সামরিক সমাধানের বাইরে অন্য কিছু ভেবেছিল? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।’ 

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। দ্য ইনডিপেন্ডেন্টকে জোনাস আরো বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহল আরো সক্রিয় হলে ঘটনার সমাপ্তি এমন নাটকীয়, হৃদয়বিদারক হতো না। আর লিবিয়া নামক রাষ্ট্রটিও এভাবে ধসে পড়ত না।’

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে কথিত আরব বসন্তে আরো কয়েকটি দেশের মতো লিবিয়াতেও বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, গাদ্দাফির শাসনের ইতি ঘটাতে হবে; কিন্তু লিবীয় সরকার ব্যাপক দমনাভিযান চালায়। গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলামকে ওই সময় জনসম্মুখে কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন ও বিদেশি আগ্রাসন প্রতিরোধের হুঁশিয়ারি দিতে দেখা গেছে। আবার একই সময়ে শান্তি-আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে নরওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও ত্রিপোলিতে ডেকে আনেন তিনি।

২০১১ সালের ১৭ মার্চ জাতিসংঘে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের পক্ষে ভোটাভুটি হয়। এর পরের সাত মাস লিবিয়ার সামরিক বাহিনীর ওপর সাত হাজারেরও বেশি আঘাত হেনেছে ন্যাটোর যুদ্ধবিমান। ন্যাটো সদস্য হিসেবে নরওয়ে বিমান হামলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টোলটেনবার্গ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোনাস স্টোর। এসব আলোচনার আয়োজন হয় অসলোতে।

নরওয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় সংকট সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার খসড়াও করা হয়। যার শুরুতেই বলা হয়- ‘কর্নেল গাদ্দাফি ক্ষমতা ছেড়ে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ এ পরিকল্পনা নিয়ে সাইফ আল-ইসলামের সাথেও কথা বলেছেন জোনাস স্টোর। সাবেক এ নরওয়েজিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আত্মজীবনী লিখেছেন স্টেল উইগ। তিনি জানান, গাদ্দাফির পরিবার ও লিবিয়ার তৎকালীন ক্ষমতা কাঠামোর নীতি-নির্ধারকদের সবাই গাদ্দাফির ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়টিতে সমর্থন দিয়েছেন। গাদ্দাফি দেশ ছাড়ার প্রশ্নটিই শুধু সমাধান করা বাকি ছিল।

গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের হাতে আটক হন গাদ্দাফি। হত্যা করা হয় তাকে। ন্যাটোর সহায়তায় বিদ্রোহীরা গৃহযুদ্ধে জয় পেলেও মারাত্মক সংকটে পড়ে লিবিয়া। দেশটির পরের এক দশকের ইতিহাস শুধুই সংঘাত আর বিভক্তির ইতিহাস। এ সময় লিবিয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি। যদিও গত মাসে দেশটিতে নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঐকমত্যের সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে; কিন্তু তা যে দেশটিকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ নেতাদের প্রায় সবার নামেই কোটি কোটি ডলার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

জোনাস স্টোর বর্তমানে নরওয়ের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন। তার মতে, ২০১১ সালের শান্তি আলোচনাটি পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি ছিল দুঃখজনক। এর পরের এক দশকে লিবিয়ায় যা হয়েছে, তা আরো দুঃখজনক। 

জোনাস বলেন, ‘গাদ্দাফি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তেন কি-না, বা চরমপন্থী কোনো দল এ সমাধান মেনে নিত কি-না, সে বিষয়ে এখন আমরা কিছুই বলতে পারব না। তবে পশ্চিমা বড় দেশগুলো যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী ছিল না, সে বিষয়টি পরিষ্কার।’ 

তিনি আরো জানান, অসলোয় দুই পক্ষের মধ্যকার ঐকমত্যের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। এ বিষয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিছুটা আগ্রহ দেখালেও, অন্য দুই দেশের এ নিয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না। ওই সময় যদি এ নিয়ে তারা আগ্রহ দেখাত, লিবিয়ার ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত।

ছায়া যুদ্ধ

২০১১ সালের যুদ্ধ লিবিয়াকে ঠেলে দেয় আরো রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের দিকে, যা চলেছে গত এক দশক ধরে। লিবিয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) ও এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে। ত্রিপোলি আপাতত তাদের দখলেই আছে।

অন্যদিকে, পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থাকা জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমর্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি। লিবিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অত্র অঞ্চলে এক ‘ছায়া যুদ্ধের’ আবির্ভাব ঘটেছে।

লিবিয়ার যুদ্ধে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র যেমন যুদ্ধরত দুই পক্ষের একেকটাকে সমর্থন দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং মিসরও এ কাজই করছে। ইউরোপ চিন্তিত রয়েছে লিবিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে। কারণ লিবিয়ার অস্থিতিশীলতা পুরো উত্তর আফ্রিকাকে সমস্যায় ফেলেছে, যার সুযোগ নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। লিবিয়ার যুদ্ধ ইউরোপের জন্য শরণার্থী সমস্যা আরো প্রকট করেছে। ইউরোপ চাইছে জিএনএ লিবিয়ার ক্ষমতায় আসীন হয়ে ইউরোপের শরণার্থী সমস্যায় সহায়তা করুক; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত জেনারেল হাফতার ইউরোপের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত নন। 

লিবিয়ার ওপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যেভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাচ্ছে, তাতে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //