তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার নেপথ্যে

এক দশক আগে কথিত আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। সেই দেশটি এখন গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। কথিত আরব বসন্তের অন্যতম সফল দেশ বলা হলেও, আদতে তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়নি। ২০১১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার সরকার পরিবর্তিত হয়েছে দেশটিতে। গত ২৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ ক্ষমতাসীন আননাহদা পার্টির প্রধানমন্ত্রী হিশেম মেচিচিকে বরখাস্ত করেন এবং পার্লামেন্ট স্থগিত করেন। সেই সঙ্গে কাইয়েস এক মাসের রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করেন। এ রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে যেমন রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংকট, তেমনি রয়েছে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ।

অর্থনৈতিক থেকে রাজনৈতিক সংকট : তিউনিসিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ। গত কয়েক মাসে আরও খারাপ হয়েছে। এই স্থবিরতার প্রভাব গভীর ও সুদূরপ্রসারী। দেশটিতে বেকারত্ব বেড়েছে ব্যাপকহারে। গত এক দশক ধরে যারা পরিবর্তনের সুফল পাওয়ার আশায় ছিল, তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার তেমন কোনো সমাধান হয়নি। মহামারির অনেক আগে থেকেই এ সমস্যা চলে আসছে। মহামারি কেবল সেই অর্থনৈতিক সংকটকে রাজনৈতিক সংকটে রূপ দিতে ত্বরান্বিত করেছে। যা দেশটির জাতীয় অর্থনীতি এবং ক্ষুদ্র ও স্থানীয় ব্যবসার ওপর গুরুতর আঘাত হানে। 

সরকারি হিসাবেই তিউনিসিয়ায় বেকারত্বের হার বেড়ে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ২০২০ সালের শেষ নাগাদ ৩৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তিউনিসিয়ার অর্থনীতির একটি অন্যতম প্রধান খাত ছিল পর্যটন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তাতে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। উৎপাদনশীলখাতও গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২০ সালে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়।

এ ছাড়া করোনা মহামারি রোধে দেশটির সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ১৯ হাজারের মানুষের মৃত্যু হয় দেশটিতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পুরো আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিড মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি তিউনিসিয়ায়। প্রায় এক কোটি ২০ লাখের কাছাকাছি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে দেশটির সরকার।

সাংবাদিক ও লেখক আকরাম বেলকায়েদ বলেন, ‘তিউনিসিয়া হচ্ছে একমাত্র আরব দেশ যেখানে একটা স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র আছে। এখানে অবাধ নির্বাচন হয়, লোকজন জেলে যাবার ভয় ছাড়াই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাতে পারে। এখানকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেই আপনি এটা বুঝতে পারবেন, যেগুলোতে হয় গৃহযুদ্ধ, নয় তো একনায়কতান্ত্রিক শাসন চলছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘তিউনিসিয়াকে দেখা হয় আরব বসন্তের একমাত্র সাফল্য হিসেবে; কিন্তু এখানে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে- যা করা হয়নি।’

২০১১ সালে গণআন্দোলনের মুখে তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বেন আলি উৎখাত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তিউনিসিয়ায় ৯টি সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং বিদায় নিয়েছে। কোনো কোনো সরকারের আয়ু ছিল মাত্র কয়েক মাস। কোনো সরকারই মৌলিক রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন করেনি, করতে চায়নি। এ সময়ে স্বৈরশাসকের আমলে সুবিধাপ্রাপ্তদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এর প্রতিফলন দেখা যায় ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ একসময় ছিলেন সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তার তেমন কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও ছিল না। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন।

চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ দানা বাঁধে। এক পর্যায়ে জনগণ রাজপথে সরকার পতনের আন্দোলনে নেমে পড়ে। গত মাসখানেক ধরে এ আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনকারীদের মূল ক্ষোভ ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা গিয়ে পড়ে সরকারের উপর। সরকার পতনের পর আন্দোলনকারীরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও, এটি তাদের কাছে প্রকৃত বিজয় নয় বলে উল্লেখ করেছেন। তারা প্রকৃত রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করেন। অপরদিকে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আননাহদাসহ অনেক বিশ্লেষকরা এটিকে ‘রাজনৈতিক ক্যু’ বলে মনে করছেন।

উল্লেখ্য, তিউনিসিয়ার সরকার ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা প্রায় সমান। এটি দ্বৈত-নির্বাহী ব্যবস্থা। তবে এখানে রাষ্ট্রপ্রধান হলেন প্রেসিডেন্ট, সামরিক বাহিনী তার অধীনে থাকে। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনরোষ এবং সেনাবাহিনীকে কাজে লাগান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ।

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : কথিত আরব বসন্তের পর ইসলামপন্থী ও সেক্যুলারদের মধ্যকার আলোচনা সঠিক সমাধানের দিকে না এগোনোয় সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসরে গণতান্ত্রিক উত্তরণ না হয়ে গৃহযুদ্ধ ও স্বৈরশাসনে পতিত হয়েছে। তবে তিউনিসিয়ায় দেখা যায় এক ভিন্ন আখ্যান। ইসলামী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আননাহদা ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে না এনে সেক্যুলার ও অন্যদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্র সামনে আনে। ফলে উদারপন্থী, সেক্যুলারদের একাংশ এবং ফরাসি উপনিবেশবিরোধীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী তারা। আননাহদার শক্ত অবস্থান সৌদি-আমিরাত-ফরাসি বলয়ের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও স্বার্থ রক্ষায় প্যান-ইসলামিক উদ্যোগ জোরদার করেছেন। এ ক্ষেত্রে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে তুরস্ক। এ ছাড়াও ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড, তিউনিসিয়ার আননাহদার সঙ্গে এরদোয়ান ও তার গণতান্ত্রিক ইসলামী দল এ কে পার্টি আদর্শিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই রাজনৈতিক ইসলামকে যেমন পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েল নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে, তেমনি আরবে তাদের রাজতান্ত্রিক- স্বৈরতান্ত্রিক মিত্রদের জন্যও এটি আতংকের কারণ। যে কারণে আফগানিস্তানে তালেবানের মতো একটি কট্টরপন্থী ইসলামী দলকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত থাকলেও মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড পুনরায় ক্ষমতায় আসুক, বা তিউনিসিয়ায় আননাহদা পার্টি ক্ষমতায় থাকুক, এটি পশ্চিমারা কখনোই চাইবে না। 

মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে একটি তুরস্ক-বিরোধী বলয়ের ভিত শক্ত করে চলেছেন জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন। বিশ্লেষকরা বলছেন, কথিত যুদ্ধবিরোধী অবস্থান বজায় রেখে, সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ না করে যেসব দেশে মার্কিন বলয়ের বাইরের সরকার থাকবে, সেসব দেশে বিরোধী দলগুলোকে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করে সরকারের পতন ঘটানো হলো ডেমোক্রাট প্রশাসনের গতানুগতিক পররাষ্ট্রনীতি। বাইডেন প্রশাসন সে পথেই হাঁটছে। তিউনিসিয়ার আননাহদা পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এটিকেও অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

কায়েস সাইয়েদ যদি জনগণকে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সুফল দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে আজ যারা তাকে সমর্থন দিচ্ছেন, তারাও তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে দেরি করবেন না। তিউনিসিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস এমনটিই বলে। আর সে ক্ষেত্রে পরবর্তী রাজনৈতিক ভিকটিম হতে কায়েস সাইয়েদের হাতে সময় খুব বেশি নেই! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //