বছর ঘুরলেও শান্তি ফেরেনি টিগ্রেতে

ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনী ও টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে চলমান যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হলেও ফেরেনি শান্তি। যুদ্ধরত সব পক্ষের বিরুদ্ধেই উঠেছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ। টিপিএলএফ যেমন অল্পবয়সীদের যুদ্ধের হাতিয়ারে পরিণত করেছে, বিরোধী সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছে; তেমনি আমহারা ফ্রন্ট, ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তির আহ্বান দায়সাড়া বক্তব্য হয়েই থেকেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর উদ্যোগ এই এক বছরে দৃশ্যমান হয়নি।

টিগ্রেতে গত বছরের নভেম্বর থেকে সংঘর্ষ চলছে ইথিওপিয়ার সরকার ও টিপিএলএফের মধ্যে। বিদ্রোহীদের রুখতে সেনা পাঠিয়েছিল সরকার। দুই পক্ষের লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গৃহহীন হয়ে ক্যাম্পে বসবাস করতে হচ্ছে বহু মানুষকে। বহু মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্য, তীব্র খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে দেশটিতে। নারী-শিশুদের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। এ পরিস্থিতিতে অঞ্চলটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮০-এর দশকে যেমন দুর্ভিক্ষের মূলে ছিল সরকারি দমন-পীড়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা; তেমনি এবারও দুর্ভিক্ষের মূলে রয়েছে একই মানবসৃষ্ট কারণ।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) মুখপাত্র টমসন ফিরি জানিয়েছেন, ‘টিগ্রের ৫২ লাখ বা সেখানকার ৯১ শতাংশ মানুষ অভুক্ত। এত মানুষের কাছে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা খুবই শঙ্কিত।’

জাতিসংঘের হিসাব মতে, অঞ্চলটির চার লাখের বেশি মানুষ ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছে। আরও প্রায় ১৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। ইথিওপিয়ার সরকার এমন তথ্য অস্বীকার করে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, ‘খাদ্য, পুষ্টিকর খাবার, ওষুধপত্র, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে মানব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।’

টিগ্রের অবস্থা বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সাহায্যবিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক বলেছেন, ‘ওই অঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। সেখানে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।’ জাতিসংঘের সহযোগিতা ও বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত এক সমীক্ষারভিত্তিতে তিনি এ মত প্রকাশ করেন।

সম্প্রতি জিবুতি বন্দর যাওয়ার পথে মূল রাস্তার সঙ্গে সংযোগকারী সড়কের ধারে গুরুত্বপূর্ণ কোমবোলচা শহর টিগ্রে বিদ্রোহীরা দখলে নেয়। এটা সরকারের কাছে একটা বড় ধাক্কা। টিপিএলএফ ইতিমধ্যেই টিগ্রের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। তারা টিগ্রের অন্যান্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলে টিডিএফ (টিগ্রে ডিফেন্স ফোর্স) গঠন করেছে। তারা এখন রাজধানী থেকে ৩৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।

এ ছাড়া ওলোমো লিবারেশন ফ্রন্ট (ওএলএফ) দাবি করেছে, তারা সেনার কাছ থেকে আদ্দিস আবাবা থেকে ৩২৫ কিলোমিটার দূরের শহর কেমিস দখল করে নিয়েছে। অগ্রসরমান বিদ্রোহীদের ঠেকাতে নাগরিকদের অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন ইথিওপিয়ার নোবেল বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই ইরিত্রিয়া শাসন শুরু করে ইথিওপিয়ার রাজা। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের মে মাস পর্যন্ত লড়াই করে ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতাকামীরা। ১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়া স্বাধীন হলেও, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সংঘাত বন্ধ হয়নি। বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। দেশ দুটির মধ্যে শান্তিচুক্তি করতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্যই আবি আহমেদ শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। এবার টিগ্রে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে লড়ছে ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী এবং আমহারা বাহিনী।

এ দিকে টিগ্রের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা গত ১ নভেম্বর ঘোষণা দিয়েছে, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা দখল করে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করবে তারা। ইথিওপিয়ার ও ইরিত্রিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আরও বেশিসংখ্যক কিশোর নাম লেখাচ্ছে। টিডিএফের নতুন যোদ্ধাদের অনেকেই কেবল কৈশোরে পা দিয়েছে। একটি অনিশ্চিত এবং সম্ভাব্য রক্তাক্ত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইথিওপিয়া।

তবে যে পক্ষই দখলে নিক; প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং যুদ্ধাপরাধের হুমকিতে দিন কাটাচ্ছেন ওই অঞ্চলের মানুষ। ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী ইরিত্রিয়ার সৈন্যদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। আর সে যুদ্ধে কেবল টিগ্রের বিদ্রোহী যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই নয়, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকেও লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আবি মনে করেন, টিগ্রে অঞ্চলে প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যই হামলা তীব্র করা হচ্ছে। কার্যত এ প্রশ্রয়ের ফলে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার তথ্য জড়ো হচ্ছে। পুড়ে যাওয়া গাড়ি এবং ধ্বংস হওয়া বাড়ি এখানকার নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সংস্থাটির মতে, ইরিত্রিয়ার সৈন্যরাও এই অপরাধে ব্যাপকভাবে জড়িত। দুই পক্ষের যোদ্ধাদের মরদেহ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কখনো কখনো তাদের অস্থায়ী কবরস্থানে পুঁতে ফেলা হচ্ছে; কখনো মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, অথবা ঘটনাস্থলেই ফেলা রাখা হচ্ছে। মরদেহের প্রতি অবমাননাও যুদ্ধাপরাধেরই নামান্তর।

জাতিসংঘ ও ইথিওপিয়ার মানবাধিকারবিষয়ক তদন্ত কমিটি টিগ্রে অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধে ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী, টিপিএলএফ, আমহারা ফোর্স ও ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী- সসব পক্ষকেই গণহত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। যৌথ তদন্ত কমিটি গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত টিগ্রের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ৩ নভেম্বর যুদ্ধাপরাধবিষয়ক তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট বলেন, ‘টিগ্রেতে যুদ্ধ চলছে। সেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, শরণার্থী, যুদ্ধবিরতিবিষয়ক আইন সবকিছু চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এটা যুদ্ধাপরাধের শামিল।’

ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি যুদ্ধাপরাধ করেছে। ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ার যুদ্ধ চলাকালে টিগ্রে প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী ইরিত্রিয়ার নাগরিকদের আবারও দেশে যেতে তারা ‘জোর করছে’ বলে অভিযোগ এসেছে। এ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক্সম এলাকায় ১০০ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, টিগ্রের বিভিন্ন এলাকার বাড়ি থেকে অন্তত ৭০ জন বেসামরিক লোককে ধরে এনে হত্যা করেছে তারা। আর টিপিএলএফ ফ্রন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আমহারা ফ্রন্ট, ইথিওপিয়া ও এরিত্রিয়া সেনাদের অত্যাচারের বদলা নিতে তাদের সমর্থকদের হত্যা করেছে। টিগ্রেতে ২৬৯ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে গণধর্ষণ ও নিরীহ লোকদের অঙ্গচ্ছেদের বিবরণ এসেছে। এ ছাড়াও অভিযোগ এসেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাঠালেও তা বিতরণে বাধা দিয়েছে তারা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //