আল জাজিরা বিশ্লেষণ: আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান জনপ্রিয়তার কারণ কী

মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আলী বঙ্গো। তিনি ২০০৯ সাল থেকেই দেশতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর অবশেষে গত বুধবার এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। বর্তমানে গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন বঙ্গো। । তবে অভ্যুত্থানটি মূলত প্রেসিডেন্ট বঙ্গোরই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখা রিপাবলিকান গার্ড কর্তৃক পরিচালিত ছিল। আর অভ্যুত্থানের পরপরই প্রকাশিত এক সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে ক্ষমতাচ্যুত আলী বঙ্গোকে বেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখা যায়। এ সময় তার পক্ষে ‘আওয়াজ তোলার জন্য’ দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও  জানান তিনি।

আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ এ দেশটিতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চালু ছিল বঙ্গোর শাসন ব্যবস্থা। বিপুল বিত্ত-বৈভব আর ঐশ্বর্য্যে কেটেছে তার দিন। অথচ অভ্যুত্থানের সময় তাকে দেখাচ্ছিল যথেষ্ট অসহায়।

তবে তার এমন আহবানের বিপরীতে বরং জনগণকে বঙ্গোর ক্ষমতাচ্যুতিতে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। এ সময় জনগণকে অভ্যুত্থাকারীদের সঙ্গে সেলফি তুলতেও দেখা যায়। এর আগে ১৯৬৭ সাল হতে বঙ্গোর পিতা ওমরের সময় থেকেই শুরু হয় এ পরিবারটির শাসনতন্ত্র। আর এই পরিবারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে জনগণ বেশ আনন্দিত বলেও দেখা যায়।

তবে তার এমন আহবানের বিপরীতে বরং জনগণকে বঙ্গোর ক্ষমতাচ্যুতিতে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। এ সময় জনগণকে অভ্যুত্থাকারীদের সঙ্গে সেলফি তুলতেও দেখা যায়। এর আগে ১৯৬৭ সাল হতে বঙ্গোর পিতা ওমরের সময় থেকেই শুরু হয় এ পরিবারটির শাসনতন্ত্র। আর এই পরিবারতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে জনগণ বেশ আনন্দিত বলেও দেখা যায়।

২০২০ সাল হতে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তত ১০ টিরও বেশি সামরিক ক্যু পরিচালিত হয়।  এদিকে বুধবারে দেশটির লোকেরা রাস্তায় নেমে আসেন গণতন্ত্রের পথে তাদের সম্ভাব্য জয়লাভের আশায়। 

ফ্রান্সের একটি সেনাঘাঁটির বাইরে সামরিক সরকারের সমর্থকদের বিক্ষোভ। নিয়ামে, নাইজার, ১১ আগস্টছবি: রয়টার্স

এর আগে ২৬ জুলাইয়ের ক্যু’র পর সামরিক সরকারের সমর্থনে নাইজার স্টেডিয়াম কানায় কানায় পুর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আর ২০২১ সালে গিনির সেনাবাহিনী যখন প্রেসিডেন্ট আলফা কোন্ডেকে ক্ষমতাচ্যুতির সময়েও জনগণের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গিয়েছিল। 

২০২০ সাল হতে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তত ১০ টিরও বেশি সামরিক ক্যু পরিচালিত হয়। 

অভ্যুত্থানের বিষয়ে ফেলো, আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচি ও চ্যাথাম হাউজ থিংক ট্যাংকের কোফি হফম্যান বলেন, তথাকথিক পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আমার মনে হয়, প্রকৃত ঘটনাটা হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কথা ভেবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় না, বরং মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে এমনটাই চলে আসছে এ অঞ্চলে। বহু বছর ধরেই সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়নি।

এ সময় তিনি অবশ্য ক্ষমতাচ্যুত শাসকের আহ্বান যে সাধারণের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি সে বিষয়টি তিলে ধরে বলেন, গ্যাবনের রাজপথে সেনা সমর্থনে উত্তাল জনতার আনন্দের প্রকাশ তেমনতি জানান দিচ্ছিল। 

রাজধানী লিব্রেভিলসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করতে দেখা যায় সাধারণ জনতাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় বেসামরিক নেতৃত্বের বিষয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। আর সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে তাদের এমন আশাবাদ সে হতাশারই প্রতিফলন। ফেলো লীনা কোফি হফম্যান বলেন, সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে  জনগণের এই সমর্থন সরাসরি নয়। মানুষ সেনাবাহিনীকে সমর্থন নয়, বরং তারা ক্ষমতার পালাবদল দেখতে চায়।

অবৈধ উপায়ে নির্বাচনী বৈধতা দানের প্রয়াস 

আফ্রিকার মধ্যে গ্যাবন হলো সর্বশেষ দেশ, যেখানে ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ নেতাকে ক্ষমতা থেকে অপসারন করলেন সামরিক বাহিনী। বঙ্গোর রিপাবলিকান গার্ডের প্রধান জেনারেল ওলিগুই এনগুয়েমার নেতৃত্বে একদল সেনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশপাশি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন আলী বঙ্গো।

আনুমানিক ২৩ লাখ জনসংখ্যার দেশ গ্যাবন। দেশটিতে প্রায় সাড়ে আট লাখ নিবন্ধিত ভোটার রয়েছেন। গত ২৬ আগস্ট দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট গণনার সময় কারফিউ জারি করা হয় দেশটিতে। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা আর আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষদেরও নিষিদ্ধ করেছিল বঙ্গোর সরকার।

এদিকে অভ্যুত্থানের বদৌলতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়া জেনারেলরা বলছেন, বঙ্গোকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের অন্যতম কারণ নির্বাচনে জালিয়াতি। শুধু গ্যাবন নয়, পুরো আফ্রিকার নির্বাচনী ব্যবস্থাই বিতর্কিত।

গ্যাবনে সংঘটিত অভ্যুত্থানের দিন আফ্রিকার আরেক দেশ জিম্বাবুয়ের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এমারসন এমনানগাগওয়া পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরাও ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সম্প্রতি আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বোলা তিনুবু। মূলত বেলা তিনুবু সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারিত নাইজারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে ক্ষমতায় ফেরাতে আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দানকারী। 

গ্যাবনে সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে তিনি বলেন, এ অভ্যুত্থান এটাই জানান দিচ্ছে যে আফ্রিকা মহাদেশে ‘স্বৈরাচারের সংক্রমণ’ ঘটেছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে নাইজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা।পরে ওই জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে বিরোধী দলগুলো আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

অভ্যুত্থানের পর দেওয়া ভিডিও বার্তায় গ্যাবনের গৃহবন্দী প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো। ছবি: এএফপি

গত বছর আফ্রিকার দেশগুলোতে একটি জরিপ পরিচালনা করে আফ্রিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রোব্যারোমিটার। জরিপে অংশ নেয়া মহাদেশটির মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অপছন্দের প্রার্থীকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা সম্ভব। চলতি বছর একই প্রতিষ্ঠানের করা আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দেশটির মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। গত দশকে যেখানে ৭৩ শতাংশের গণতন্ত্রে আস্থা ছিল, এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮।

আফ্রিকার দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টরা তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচন দিয়ে থাকেন ঠিকই কিন্তু আসলে তা নিতান্তই নিয়ম রক্ষার একতি প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো তার একটি উদাহরণ। 

উগান্ডা, রুয়ান্ডা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ক্যামেরুনের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্টরাও অন্তত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জোরপূর্বক আঁকড়ে ধরে আছেন।

প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জীবনমানের ক্রমবর্ধমান অবনমনের ফলে গণতন্ত্রের সুফল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তুলছেন এ মহাদেশের জনগণ। 

নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমূখী দাম এর সঙ্গে আফ্রিকার জনজীবনে এনে দিয়েছে চরম দুর্দশা। আর নিত্য সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও বাড়ছে ক্রমাগত। বাড়ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। 

বিশ্ব্যব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, চলতি বছরের শেষ নাগাদ আফ্রিকার অর্থনীতির আকার বাড়ার বদলে ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমবে। যেখানে এর আগে গত বছর এই হার ছিল ৩ দশমিক ৬।

আর অর্থনীতির সামগ্রিক এমন কঠিন পরিস্থিতি ও দুরবস্থার ফলে বেসামরিক নেতৃত্বের ওপর জনগণের সমর্থন কমে আসছে। যদিও দেখা যায়, এসব নেতা ‘গণতান্ত্রিক’ উপায়ে নির্বাচিত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের প্রতি সমর্থন রেখেছে। 

সরকার পরিবর্তনের এমন আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে আরও একটি কারণ রয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের আর সেটি হলো বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকা।

সুদান বাদে গত পাঁচ বছরে আফ্রিকার যেসব দেশে সেনা অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়েছে সেসব দেশে একসময় ফ্রান্সের ঔপনিবেশ ছিল। দেশগুলোর সরকারের ওপর প্রভাব, বিস্তারের পাশাপাশি কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পক্ষ নেওয়া ও তাদের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ায় ফ্রান্সকে দায়ী করে থাকে সাধারণ মানুষ।

আর জনগণের ফ্রান্সবিরোধী এমন মনোভাব কাজে লাগাচ্ছেন অভ্যুত্থানকারী জেনারেলরা। তারা ফরাসী বিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনগণকে কাছে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকা ও এর সুফল না ভোগ করতে পারায় আফ্রিকার মানুষ সেনা অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে থাকছেন। তবে এ বিষয়েও তাদের শঙ্কা- যে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় সাধারণ মানুষ সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, সে সরকারও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজে আসবে না। কারণ হিসেবে জনগণের জন্য নয় জেনারেলদেরও লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাটলাস নেটওয়ার্কের সেন্টার ফর আফ্রিকান প্রসপারিটির ফেলো ইব্রাহিম আনোবা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা অনেকটাই শরীরে ঘা হওয়ার মতো। যা চুলকালে ক্ষণিকের জন্য আরাম পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু চুলকানোর কারণে এর অবস্থা হয় আরও বেগতিক। আর চুলকানির মতো সাময়িক স্বস্তিই যেন হয়ে আসছে সামরিক বাহিনী।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //