আফ্রিকার দেশগুলোতে কেন বারবার সেনা অভ্যুত্থান

আফ্রিকার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের চেয়ে সেনা অভ্যুত্থানের প্রবণতা বেড়ে চলছে। এই মহাদেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়নের জন্যই সামরিক অভ্যুত্থানের বৈধতা দাবি করছে ক্ষমতা দখলকারীরা। ২০০৯ সাল থেকে মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলী বঙ্গো। গত ৩০ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি এখন গৃহবন্দি। এ অভ্যুত্থান করেছে মূলত বঙ্গোরই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখা রিপাবলিকান গার্ড।

আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশটিকে এক যুগের বেশি সময় শাসন করেছেন বঙ্গো। বিপুল বৈভব আর ঐশ্বর্যে দিন কাটিয়েছেন। তবে সেদিন তাকে দেখে অসহায় লাগছিল। অবশ্য ক্ষমতাচ্যুত শাসকের এই অসহায়ত্ব যে সাধারণের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি, তার প্রমাণ দেখা গেল গ্যাবনের রাজপথে। রাজধানী লিব্রেভিলসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করছে সাধারণ জনতা। অনেকে সেনাদের সঙ্গে ছবি তুলছে। ১৯৬৭ সালে বঙ্গোর বাবা ওমর আলীর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার মধ্য দিয়ে পরিবারটির যে আধিপত্য চলছিল দেশটিতে, দৃশ্যত তার অবসান ঘটায় সেনাদের বাহবা দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আফ্রিকার দেশগুলোতে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটছে। এর বদলে উত্থান হচ্ছে নতুন নতুন সেনাশাসকের। ২০২০ সাল থেকে আফ্রিকায় ১০টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। এসব অভ্যুত্থানের বেশির ভাগই হয়েছে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং গণতন্ত্রের এ পতনে উল্লাস করতে দেখা গেছে এসব দেশের মানুষকে। 

গ্যাবনের আগে আফ্রিকায় সর্বশেষ অভ্যুত্থানটি হয়েছে গত ২৬ জুলাই, নাইজারে। অভ্যুত্থানের পর দেশটির জেনারেলরা রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল নেন। সেই সামরিক সরকারের সমর্থনে স্টেডিয়ামগুলো ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এরও আগে ২০২১ সালে অভ্যুত্থান হয় গিনিতে। জনগণের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলফা কোন্দে। গিনির অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল দেশটির জনতার বড় অংশ। সেনাদের ক্ষমতা দখল উদ্যাপন করেছিল তারা। অগণতান্ত্রিক পন্থায় ও জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করলেও আফ্রিকার মানুষ কেন এভাবে সমর্থন জানাচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফ্রিকায় বেসামরিক নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ। সামরিক নেতৃত্ব নিয়ে তাদের এ আশাবাদ সে হতাশারই প্রতিফলন। 

আবার তাদের কেউ কেউ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পক্ষে সামরিক বাহিনীকে দাঁড় করানোর সম্ভাব্য পাঁচটি মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি দেখাচ্ছেন। 

১. আফ্রিকার এই সব দেশের স্বৈরতন্ত্রকে বিপ্লব ছাড়া উৎখাতের সামর্থ্য রাখে সেনা কর্মকর্তারা।
২. তারা মনে করে এই সব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলছে।
৩. তারা দেখছে এই সব রাজনৈতিক স্বৈরশাসকদের শাসন ক্ষমতায় আসার পথটি বৈধ নয় এবং তারা ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
৪. এই সব দেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক স্বৈরশাসন জাতীয় সংকট তৈরি করছে এবং জনগণ সেনাবাহিনীকেই এই সংকটের পরিত্রাতা হিসেবে মনে করছে।
৫. এই সুযোগে আঞ্চলিক জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক মৌনতার মধ্যে তারাই জনগণকে সৈরশাসন থেকে দায়মুক্তিরকারি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আফ্রিকার এই দেশগুলোতে নিজেদের তৈরি করা মেকি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়লাভের পর সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে, জাতীয় সম্পদের তছরুপ ঘটাচ্ছে, বিরোধী মতকে নিপীড়নের পথে দমন করছে। বিশেষ করে গ্যাবন ও নাইজারে এই রকম পরিস্থিতিই দেখা যাচ্ছিল। তাই এই সব দেশের জনগণ গণতন্ত্রের প্রতিই আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং সামরিক শাসনকেই তাদের যন্ত্রণা লাঘবের কা-ারি মনে করছে। গত বছর আফ্রিকার দেশগুলোতে একটি জরিপ পরিচালনা করে আফ্রিকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রোব্যারোমিটার। তাতে দেখা যায়, মহাদেশটির মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অপছন্দের প্রার্থীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা যায়। চলতি বছর একই প্রতিষ্ঠানের করা আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দেশটির মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা কমছে। গত দশকে যেখানে ৭৩ শতাংশের গণতন্ত্রে আস্থা ছিল, এ বছর তা কমে হয়েছে ৬৮।

আফ্রিকার দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টরা সময় পেরোলে নির্বাচন দেন ঠিকই, যা নিতান্তই নিয়ম রক্ষার। গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো তার একটি উদাহরণমাত্র। উগান্ডা, রুয়ান্ডা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ক্যামেরুনের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্টরাও অন্তত দুই দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন। বিভিন্ন ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশেই জনপ্রিয় এবং নির্বাচিত সরকারকে সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাতে কলকাঠি নাড়ত সাবেক পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভুরা। কিন্তু আফ্রিকার এখনকার সেনা অভ্যুত্থানগুলো তাদের সাবেক পশ্চিমা ঔপনিবেশিক প্রভুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটছে। বরং অভ্যুত্থানকারীরা পশ্চিমাদের নয়া ঔপনিবেশিক কায়দায় জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে এবং পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির কাহিনি জনসমক্ষে উদঘাটন করছে। 

আফ্রিকার মানুষ যে অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাচ্ছে, তার অন্যতম কারণ সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকা ও এর সুফল না পাওয়া। কিন্তু অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছেন যে, সুন্দর ভবিষ্যতের যে আশায় সাধারণ মানুষ সামরিক সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, সেই সরকারও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজে আসবে না। কারণ জনগণের সুফল নয়, জেনারেলদেরও লক্ষ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেওয়া। সুতরাং আফ্রিকার এই দেশগুলোতে সেনা অভ্যুত্থান জনগণের ভাগ্য কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //