সপ্তপদী- সত্যানুসন্ধানের সীমাবদ্ধতায় ঘূর্ণনরত

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন আধুনিক লেখক। একটি মহাযুদ্ধের পরে আরেকটি মহাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে বাংলা সাহিত্যে- কবিতা ও কথাসাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। যুদ্ধের বিপুল ধ্বংস মানুষের যুদ্ধপূর্ব অতীতে সব মূল্যবোধগুলোকে যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বিশ^ব্যাপী মানুষকে রিক্ত, অসহায় আর একা করে দিল, জীবন হয়ে উঠল অসংলগ্ন, খ- খ- ও নৈরাশ্যপূর্ণ সেই বিষাদিত নতুন বোধেই বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সাহিত্যের জন্ম।

সেই সময়কালের লেখকদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্মেই দেখিয়েছেন অসাধারণ মুন্সিয়ানা, জীবনবোধ যা তাঁর সাহিত্যকে করেছে বিষয়গত আর মন্ময়। সপ্তপদী-ও তেমনি তাঁর সাহিত্যমূল্য সমৃদ্ধ একটি মৌলিক রচনা। সেখানে দেশের সামগ্রিক শ্রেণি, বোধ ও ব্যক্তির সংকটকে অনুভব করে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেছেন। দেশ-জিজ্ঞাসা, বিশ্বরহস্য-জিজ্ঞাসা অথবা ব্যক্তির মানসিক টানাপড়েন সুন্দরভাবে এসেছে এই সপ্তপদী উপন্যাসে।

সংশয়, দ্বন্দ্ব সংকটের মধ্যে ঔপন্যাসিক জীবনের সত্য অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন তারাশঙ্কর। সপ্তপদী উপন্যাসের রিনা ব্রাউন একটি বিচিত্র ও জটিল চরিত্র। যার জন্য এই উপন্যাসের নায়ক কৃষ্ণেন্দু তার ধর্ম ত্যাগ করে ক্রিশ্চান হয়েছিল, তথাপিও রিনা তাকে গ্রহণ করেনি। রিনা ব্রাউনের ধারণা- একটি মেয়ের জন্য সে এতদিনের ধর্মত্যাগ করতে পারে, তবে অন্য প্রলোভনে সেই মেয়েটিও কৃষ্ণেন্দু ত্যাগ করতে পারে। রিনা কৃষ্ণেন্দুকে ভালোবাসে, কিন্তু ধর্মান্তরিত কৃষ্ণেন্দুকে সে বিয়ে করতে পারে না। বাকি জীবন নান হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করে। রিনা কৃষ্ণেন্দুকে ত্যাগ করার পর জানতে পারে সে ধর্মে তার কোন অধিকার নেই, আয়াকুন্তী তার মা আর সে জেমস ব্রাউনের জারজ সন্তান, যা তার ধর্মবোধকে প্রচ- নাড়া দেয়।

ধর্ম থেকে, বিশ্বাস থেকে, পরিবার ও সমাজ থেকে সম্মিলিত প্রত্যাখান রিনাকে প্রায় উন্মাদ করে দেয়- একবিশ্বাসহীন, ঈশ্বরহীন চরম শূন্যতা তাকে গ্রাস করে। ঈশ্বর ধর্ম কোনো কিছুর ওপর আমার কোনো অধিকার নেই। ঈশ্বর মূক, কোনো ভাষা নেই তাঁর, তিনি প্রতিবাদ করেননি, ধর্মের মধ্যে তালা রীতির কোড মেলেনি বলেই খোলেনি। আমি সামনে দেখেছি নরকের সিংহদ্ধার খোলা- তার মধ্যে ঢুকেছি।’ শিক্ষা, রুচি, সম্ভ্রম প্রবল অভিমানে ভেসে যায়- সে অভিমান ঈশ^রের প্রতি। স্বইচ্ছায় নিজেকে ঝাসিয়ে দেয় পঙ্কিলতার স্রোতে, সেখানে সে দেখতে চেয়েছে নরকের সীমানাকে।

আত্মধ্বংসী অভিমান তাকে যখন বিকারগ্রস্ত করে তোলে, মৃত্যুই যখন তার প্রতিনিয়ত কামনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়, তখন আবার তার সামনে আসে কৃষ্ণেন্দু, রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বাকী, যে বলেছিল- ‘তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই বন্ধুত্ব হঠাৎ কোন একদিনের আকস্মিক ঘটনার ফলে বা একদিনের আকস্মিক কোনো আবেগের উদ্ভাস নয়, অত্যন্ত সহজভাবে স্বছন্দ গতিতে। এই ফুল ফোটার মতো।’ সেই কৃষ্ণেন্দু আবার পরম মমতায় তাকে সুস্থ পথে ফিরিয়ে আনে। ঈশ্বরের প্রতি অবিচল বশ্বাস, তার অন্তরের প্রশান্তি’ তার মানবসেবার মহত্ত্ব রিনাকে ফিরিয়ে আনে ধ্বংসের মুখ থেকে। আবার ফিরে আসে রিনা জীবনের আলোকোজ্জ্বল পথে।

রিনার জীবনে বিপর্যয়, বেদনা সব কিছুই পাঠক হৃদয়কে নাড়া দেয়। কিন্তু ধর্মত্যাগের কারণে কৃষ্ণেন্দুকে ফিরিয়ে দেবার পটভূমি লেখক এখানে তৈরি করেননি। দেখাতে পারেননি যে প্রেমের চেয়ে রিনার ধর্মে বোধ বেশি ছিল অথবা ধর্মের চেয়েও গভীর কোনো বোধ। এর সম্ভবপর কোনো দিকই রিনা ব্রাউন চরিত্রে লেখক উন্মোচিত করতে পারেননি। রিনার বয়স, পরিবেশ কৃষ্ণেন্দুর প্রতি প্রেম কিছুই তার অস্বীকৃতির অনুকূল নয়।

কৃষ্ণেন্দুর জীবনে ব্যর্থতার হাত ধরে বিশ্বাস এসেছে- পরমের সম্মানে লাভ করেছে প্রশান্তি। ঈশ্বরের বিশ্বাস, আর্তের সেবা এইটুকুই যথেষ্ট ছিল কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের জন্য কিন্তু তাকে সাধু বানানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না লেখকের, কারণ সব কিছু অতিক্রম করে কৃষ্ণেন্দু মানুষই। মনে হয় তারাশঙ্কর কিছু স্থির বক্তব্য প্রকাশে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে গেছেন- বিচারের চেয়ে আবেগই বেশি কার্যকর হয়েছে, কিন্তু অখ- বাস্তবতার মধ্যে, জীবনের সমগ্র স্বরূপের মধ্যে তার সম্মান ব্যপ্ত হয়নি, সে জন্য সত্যানুসন্ধানে এক প্রকারের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় তার এই উপন্যাসে। গভীর মানব জীবন-জিজ্ঞাসা থাকলেও মহৎ শিল্প পরিণতি দেখা যায় না- অপূর্ণতা, খ-ন রয়েই গিয়েছে।

সব কিছুর পর সাহিত্যকর্ম কাল্পনিক আবহে উপস্থাপিত হয়। বাস্তবতাকে অতিক্রম করে গিয়ে সুদূরের বাস্তবতাকে টেনে আনে হয় স্বপ্ন দেখায়। ওটা- ব্যর্থতার মাপকাঠি নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //