বই প্রকাশে সেল্ফ সেন্সরশিপ

বইমেলার শেষ দিন আজ। প্রতিবছরেই দেখা যায় শেষের দিনেও অনেক বই প্রকাশিত হয়। মেলায় প্রবেশ করে টাটকা-গরম মলাটবদ্ধ পৃষ্ঠা। স্টলে স্টলে সজ্জিতবেশে প্রদর্শিত হয়ে এসব বই চলে যায় পাঠকের হাত ধরে রিডিং রুমে।

মেলার ২২তম দিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমাপড়া বইয়ের সংখ্যা তিন হাজার ৬৩১। এর বাইরে জমা না-পড়া বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। শেষ দিন পর্যন্ত হয়তো তা ছাড়াবে পাঁচ হাজার বা তারও বেশি- বাংলা একাডেমি কি জানে এসব বই কিসের বই, কোন বই, কেমন বই! রঙিন মলাটে আবদ্ধ এসব বই কতটুকু মানের, গুণের, বুদ্ধির, বিবেচনার ও মুক্তচিন্তার?

বাংলা একাডেমির আছে মেলা মনিটরিং কমিটি, তারা কতটুকু মনিটরিং করছে তা নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। কারো কারো মতে, বছর বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিসর যে বাড়ছে তাতে বাড়ছে হালুয়া-চটপটির দোকান, বাড়ছে লুচি-কাবাবের দোকান, বাড়ছে নামকাওয়াস্তে বইয়ের দোকান। অথচ বইমেলার মতো সৃজনশীল ও একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি মেলায় তারা স্থান পেয়ে যাচ্ছে দাপটের সঙ্গে! 

ভাষাচিত্র প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী খন্দকার সোহেল জানান, “বাংলা একাডেমির মনিটরিং সেলের কাজ ‘কাজীর খাতায় আছে, প্রয়োগে নেই’। তাদের দেখভালের অভাবে বইমেলা সৃজনশীলতা, মুক্তিবুদ্ধির বিকাশের হিসাবে বাতিল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মেলায় এমন স্টলও আছে যারা মৌসুমি ব্যবসায়ী, তারা মেলা এলেই পাইরেসি বই সাজিয়ে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যারা গুণগত মানকে বজায় রেখে প্রকাশনী ব্যবসা করছে, সবদিক মেনে সৃজনশীলতা, মুক্তচিন্তার বিকাশে কাজ করছে তাদের শত নিয়ম দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

কোন বই করা যাবে, কোন বই করা যাবে না- এমন শত কথা বলে মুক্তচিন্তার বিকাশকেও রোধ করে বাংলা একাডেমি। এখানে নেই একজন লেখকের লেখার স্বাধীনতা, নেই প্রকাশকেরও সব ধরনের বই প্রকাশ করার স্বতঃস্ফূর্ততা। এত বাধার ভেতরে প্রকাশকরা সেল্ফ সেন্সশিপেই বই প্রকাশ করছেন। লেখকদের মধ্যেও কাজ করছে সেল্ফ সেন্সরশিপ। আন্তর্জাতিকভাবে ফ্রিডম অব পাবলিশার্স ও ফ্রিডম অব রাইটার্স বলতে যা আছে, এখানে তা অকল্পনীয়।” 

শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, ‘মুক্তচিন্তা এখানে মরে গেছে। মেরে ফেলা হয়েছে। মুক্তচিন্তা নেই বলেই বরফের স্তূপ বাড়ছে। বই বলতে আমরা যা বুঝি, তা হতে হবে মুক্তচিন্তার। নিয়মের মধ্যে, বাধার মধ্যে একজন লেখক কখনো লিখতে পারেন না; তার সত্য ভাবনাটা প্রকাশ করতে পারেন না। প্রকাশক তা তুলে ধরতে পারেন না। চিন্তার বিকাশ যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে রক্তচক্ষুর শিকার হবে- সে সমাজ, রাষ্ট্র বিকশিত হবে না। হবে, অনেক কিছু হবে কিন্তু বোধের জায়গায় যাওয়া হবে না কোনোদিনও। এ দায় রাজনীতির যেমন আছে, রাষ্ট্রের যেমন আছে, তেমনি বইমেলা ও তার বাংলা একাডেমিরও কম নয়। দায় আমাদের সবারই।’ 

বইমেলার মনিটরিং ও বইয়ের সেন্সরশিপ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও অমর একুশে গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা কোনো বই বা লেখার সেন্সর করি না। বাংলা একাডেমি থেকে যে বই বের হয়, তা প্রিভিউ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকাশিত হয়। আর মেলার অন্য বইয়ের দায়িত্ব আমাদের না। প্রকাশনা সমিতির।’ 

বইমেলার মূল দায়িত্ব বাংলা একাডেমির, এখানে দায় কি শুধুই প্রকাশনীর? এ প্রশ্নের জবাবে ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘লেখকরা যা লেখেন, মুক্তচিন্তা থেকেই লেখেন। সেখানে আমাদের বাধা-নিষেধ নেই। মুক্তচিন্তার নামে যদি ভিন্ন কিছু থাকে, তার জন্য আমাদের মনিটরিং সেল আছে, তবে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে আমরা তা দেখি, অন্যথায় নয়। এত এত বইয়ের মনিটরিং করাটা সম্ভব কি?’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বইমেলা, মুক্তচিন্তা, মুক্তচিন্তার বই ও লেখালেখি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি মুক্তচিন্তা বলছি না, আমি বলছি বিপরীত চিন্তা। গতানুগতিক ধারার বাহিরে গিয়ে সত্য ও বিশাল চিন্তার জায়গা এখানে নেই। শুধু বইমেলা নয়, লেখালেখির জায়গাটিতে এর ভাটা পড়েছে এখন।

নানাবিধ কারণে বিপরীত চিন্তার লেখকরা সরে গেছে এই জায়গাটি থেকে। জীবন সবার আগে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, গুম, ক্রসফায়ার, ব্লগার হত্যা ইত্যাদি কারণে গত পনেরো বছরের তুলনা করলেই এটি স্পষ্ট। গত বছরও দেখেছি কিছু প্রকাশনী বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমি এখনো পুরনো ধাঁচের, সৃষ্টিশীলতার দিকে নেই তাদের নজরদারি। সব মিলিয়ে বাংলা একাডেমি যেহেতু যখন যে সরকার আসে সে সরকারের প্রতিষ্ঠান, সেহেতু তাদের কাছে মুক্তচিন্তার প্রত্যাশা ভুল। তবে রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক অবস্থার কারণেই মুক্তচিন্তার জায়গাটি ম্লান হয়েছে। এর ফল শুভকর নয়।

কেননা, পৃথিবীর যেখানেই মুক্তচিন্তার অভ্যাস নেই, চর্চা নেই, বিপরীত চিন্তাকে সুযোগ দেওয়া হয় না, পৃথিবীর সেখানেই একটি বলিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। লেখকরা না লিখলে পাঠকরা পড়বে কোত্থেকে! না পড়তে পারলে শিড়দাঁড়া দাঁড়াবে কী করে? ধরুন, বইমেলা শুরুর আগে- পুলিশ বই চেক করবে, মামলা মোকদ্দমা হবে, ভিন্ন কিছু পেলে নিষিদ্ধ করা হবে ইত্যাদি শর্ত!

এগুলো একজন লেখককে মুক্তচিন্তা করতে নিরুৎসাহিত করে। কোন শব্দটা কার পক্ষে গেল, কোন বাক্যটা কার দিকে গেল- এত বিবেচনা করে তো লেখক লিখতে পারবেন না; তাই না? লেখককে চিন্তার জায়গা দিতে হবে, না হলে বইমেলা, লেখক, প্রকাশক, মান-মনন চলার জন্যই চলে যাবে মাত্র। সুফল দুষ্কর।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘বইমেলা বাংলা একাডেমির দায়িত্বে হয়। এ দায় তাদের। মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তচিন্তাকে যদি তারা তাদের দক্ষতা দিয়ে বের করে আনতে না পারেন, তবে ব্যর্থতা তাদের। রাষ্ট্র বলেন, রাজনীতি বলেন, সমাজ বলেন, সংসার বলেন- সব কিছু, সব কিছুর মতোই চলবে। বাংলা একাডেমিকেও তার জায়গাটা শক্ত রেখে চলতে হবে। পুলিশ কেন বই চেক করবে? বই চেক করবে বাংলা একাডেমি। তারা প্রকাশনীকে বাধ্য করবে চেক করতে। ভুলে ভরা বই যেমন আনা যাবে না, তেমনি মানবিক বোধে মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ করতে হবে।

তাদের বাধা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে রোধ করে রাখলে চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারলে লেখকের লেখার স্পৃহা হারিয়ে যাবে, চিন্তার জায়গা ভোঁতা হয়ে যাবে। রাষ্ট্রে যে নিরাপত্তাহীনতা চলছে, তাও মুক্তচিন্তার বাধার জন্য দায়ী। রাষ্ট্রকেও নজর দিতে হবে। নানান মতকে প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ভিন্নমত থেকে শিখতে হবে। মানুষ তো সহমত থেকে শেখে না, ভিন্ন মত থেকেই বেশি শেখে, শেখার থাকে। সে জায়গাটিকে রাষ্ট্র উন্মুক্ত করলে ভালো। বইমেলায় সকল চিন্তার, ভাবনার বই যেন আসতে পারে, বাংলা একাডেমি তার পথ সুগম করতে পারে, করা উচিত।

আবার লেখকদেরও এমন লেখা উচিত নয়, যা অকল্যাণের পথকে প্রশস্ত করে, সংযত হয়ে চিন্তাকে প্রকাশ করতে হবে। প্রশাসন বই চেক করবে না বলে, বলা উচিত- ক্ষতিকর কিছু থাকলে আইনত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তা বাংলা একাডেমির মাধ্যমেই হলেই ভালো। কারণ বইমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমি জড়িত, পুলিশ নয়, পুলিশ তাদের সাহায্য করবে মাত্র।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মাসুদুজ্জামান মুক্তচিন্তা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি শব্দটিকে বলি সমালোচনামূলক চিন্তা। সেই চিন্তাটি এখন নেই। আপনারা জানেন, কী কী কারণে তা হারিয়ে গিয়েছে। পাঠের জায়গা থেকে সে চিন্তার পাঠ এখন পাই না। পেলে ভালো হতো। সমালোচনামূলক চিন্তার পাঠ না পেলে অনেক কিছুই জানা যায় না। এই পথটিকে রোধ করা মানেই হলো জ্ঞানের একটি পথকে বন্ধ করে দেওয়া। সমালোচনামূলক পাঠের সুযোগ পেলে পাঠক যেমন উপকৃত হয়, জীবনযাপনের চর্তুরদিকই চোখ খোলা হয়। সমালোচনা হলো আয়নার মতো- এর সামনে দাঁড়ালে নিজেকে দেখা যায়।’

বইমেলায় বই হয়তো আসবে হাজার হাজার; সে বই যদি মননকে সমৃদ্ধ করতে না পারে, জ্ঞানকে বৃদ্ধি করতে না পারে, বোধকে না পারে শানিত করতে, তবে হাজার হাজার কেন, কোটি বইও কি পারবে আমাদের শেখাতে একটি বাক্য- যা দিয়ে কল্যাণ হবে মানবের, জীবনের, বিশ্বকে দেখার? বইমেলার আয়োজনে বাংলা একাডেমির মানের প্রশ্ন তো পুরনো, বইয়ের মানে বাংলা একাডেমি কী করতে পারছে- তাও এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলা একাডেমি কি একটি অগ্রসর অভিযানে নেমেছে, না কি কোনো পক্ষের হুকুম জাহির করতে বসেছে তা বাংলা একাডেমির কর্ম দিয়েই প্রকাশ করতে হবে। আজকে স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলা একাডেমি বলি আর রাষ্ট্র বলি- বইয়ের উচ্চতর উন্নয়নে, প্রকাশনা শিল্পকে আরও উন্নত করতে আজও আমাদের দেশে একটি বইয়ের বাজার নেই কেন? এ দায় কার, কাদের? আমরা কেউ এ দায় থেকে বাঁচতে পারি না। মুক্তচিন্তা বলি, সমালোচনামূলক চিন্তা বলি আর ভিন্ন চিন্তা বলি- লেখকের লেখার স্বাধীনতা খর্ব করে, প্রকাশকের স্বাধীনতায় নিয়ম বেঁধে দিয়ে একটি পড়ুয়া জাতিকে বেশি দূর নেয়া সম্ভব নয়। দায়ের জন্য দায়সারা কাজ করাই যায়; দায়িত্বের সঙ্গে, কর্তব্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন সহজ নয়। এ কঠিন কাজটি বাংলা একাডেমি যেদিন করতে পারবে, সেদিনই বইমেলার, বইয়ের চেহারা পাল্টে যাবে- বই হবে উন্মুক্ত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //