একজন ভালো প্রকাশক, ভালো পাঠক তৈরির কাজটিও করেন

শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ মেলা বাংলা ভাষাভাষী লেখক-প্রকাশক-পাঠকের এক সম্মিলন ক্ষেত্র। অমর একুশের এ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিলো- কিছু প্রশ্নও করা হয়েছিলো সাম্প্রতিক দেশকাল-এর সাহিত্য বিভাগের পক্ষ থেকে, মেলায় তাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এবারের আয়োজন- প্রকাশকের মুখোমুখি। গ্রন্থনা করেছেন- জি এ এইচ শাহীন।

একজন ভালো প্রকাশক, ভালো পাঠক তৈরির কাজটিও করেন: মাহরুখ মহিউদ্দিন

ব্যবস্থাপনা পরিচালক- ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)

অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে ঘিরে আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি কেমন?

আমাদের প্রস্তুতি এক অর্থে গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে, অন্তত পরিকল্পনার জায়গা থেকে। মেলায় আমরা শুধু নতুন বই নিয়ে নয়, নতুন সাজ নিয়েও আবির্ভূত হতে চাই আমাদের প্রিয় পাঠকদের কাছে। গত বছর থেকেই আমাদের পরিকল্পনায় ছিল মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ইউপিএল অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সাত বছরের অভিযাত্রাকে উদ্যাপন করবে।

তাই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ ছাড়াও অন্যান্য যে ৯টি ভাষায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর প্রচ্ছদের অংশ দিয়ে আমাদের প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়েছে। স্থপতি মুস্তফা আমিন নকশাটি তৈরি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তার স্মৃতির প্রতি এটি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এবারের মেলায় আপনার প্রকাশনা সংস্থা থেকে যে সব গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে- সেখানে কী ধরনের গ্রন্থের পান্ডুলিপি প্রাধান্য পেয়েছে?

প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউপিএল সবসময়ই গবেষণাধর্মী ননফিকশনের অনুবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। গতবারের মেলায় য়ুভাল নোয়াহ হারারি’র স্যাপিয়েন্স গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় এবং পাঠকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

এবার গ্যারি জে. বাস রচিত ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার ও একটি বিস্মৃত গণহত্যা (অনু. নিয়াজ মোর্শেদ কাদরী) ও ইয়ান অ্যালমন্ড রচিত নীরদ সি. চৌধুরীর মন : ইসলাম, সাম্রাজ্য ও হারানোর বেদনা (অনু. হাসান আল জায়েদ ও রায়হান রহমান)- এই দুটি অনুবাদ গ্রন্থ মেলায় হাজির করার পরিকল্পনা রয়েছে।

আরো থাকবে সাহিদুর রাহমানের গবেষণাগ্রন্থ আলো আঁধারের হাতছানি: বিশ্বায়নের ঘোরপ্যাঁচে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আরো বহু শাখায় অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ আমরা আনছি।

অনুবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যথাযথ অনুমতি নিয়ে ও কপিরাইট মান্য করে প্রকাশ করাকে আমরা অগ্রাধিকার দিই। এ ছাড়াও গত বছর আফসান চৌধুরী রচিত বাংলাদেশ ১৯৭১ সিরিজের প্রথম গ্রন্থ গ্রামের একাত্তর প্রকাশিত হয়েছিল। এবার সেই সিরিজের দ্বিতীয় বই, হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

নবীন-প্রবীণ লেখকদের পান্ডুলিপির ক্ষেত্রে কাদেরকে গুরুত্ব দিয়েছেন?

দেখা যাচ্ছে এবার নবীন ও প্রবীণ লেখক প্রায় সমান পরিমাণ গুরুত্ব পেয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত বা সচেতন চেষ্টা থেকে নয়। পান্ডুলিপির মান বিচারে এবং যে বইগুলো প্রস্তুতির একটি পর্যায় পেরিয়ে আসতে পেরেছে আমরা সেই বইগুলোই মেলার জন্য বাছাই করেছি। পাশাপাশি চেষ্টা করা হয়েছে নতুন লেখক ও অনুবাদকদের কাজকে স্থান দেয়ার।

এবারের বইমেলার আয়োজনে পাঠকের মনের খোরাক বা পাঠের পছন্দ পূরণে সমর্থ হবেন কি প্রকাশকরা?

পাঠকের চাহিদা পূরণ কোনো এক বছরের মেলায় অর্জন করার বিষয় নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া বলে আমি মনে করি। একজন দায়িত্বশীল প্রকাশককে যেমন বাজারের চাহিদা বা পছন্দের দিকে নজর রাখতে হয়, তেমনি তার স্বকীয়তা ও পেশাদারিত্বের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হয়।

একজন ভালো প্রকাশক ভালো পাঠক তৈরির কাজটিও করেন। আমরা এই কাজটি কতটুকু করতে পারছি, সেই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের কাজের আসল মানদ-। এটি আমাদের জন্য একটি শিখন প্রক্রিয়া। প্রতি বছর কম বেশি পাঠকের রুচি ও চাহিদা বিবর্তিত হচ্ছে।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক বাস্তবতা আমাদের নতুন নতুন চাহিদাকে সামনে তুলে নিয়ে আসছে। এই সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে, প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার সংগ্রাম সামলে আমরা পাঠকের জন্য খুব সামান্যই হয়তো সুবিচার করতে পারি। তবে এই প্রচেষ্টায় নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের ছাপ রাখতে পারলে পাঠক তা টের পান, এবং সেটাই আমাদের সত্যিকার অর্জন।

আপনার প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের মান সম্পর্কে কিছু বলবেন?

এ প্রসঙ্গে পাঠক মন্তব্য করবেন। সমালোচকরা বলবেন। আমরা নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি মান ধরে রাখতে। সম্পাদনা ও উৎপাদনের মান ঠিক রেখে দ্রুততম সময়ে প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জ প্রতিটি বইয়ের ক্ষেত্রেই থাকে। শেষ পর্যন্ত একটি বই কেমন রূপ নিচ্ছে তা গ্রন্থ নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে।

নানান কারণে নিজেরাই সবসময় সন্তুষ্ট হতে পারি না। শেখার ও মান বৃদ্ধির পরিসর অনেক ব্যপ্ত। বিশ্বের অন্যান্য বেশ কিছু দেশের কাজগুলো দেখলে আমরা উপলব্ধি করি যে- আমাদের আরো অনেক দূর যাবার আছে।

এ ছাড়াও কাগজের দামের ওপর অস্বাভাবিক কর- এখানে মানসম্পন্ন প্রকাশনাকে পাঠকের ক্রয়সীমার মাঝে রাখাকে অসম্ভব করে তুলেছে।

অন্যদিকে, এই দেশে মধ্যবিত্তের আকারও অত্যন্ত ছোট। হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বই পড়ার সংস্কৃতিকে খুব উৎসাহিত করছে, তা বলা যাবে না। সারা পৃথিবীতে প্রকাশকদের বড় ভরসা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয়। এই দিকগুলোতে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন নজর না থাকায় বাস্তবতা অনুযায়ী আমাদের প্রকাশনা শিল্প অগ্রসর হতে পারছে বলে মনে হয় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //