রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা ছিল অনন্য। ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করতেন ভারতে ব্রিটিশরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল আজ্ঞাবহ কেরানিকুল তৈরি করা; কিন্তু আমাদের সমাজের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল মানবিক শিক্ষার। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করার মতো শিক্ষার।

তাই তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন- ‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়, ডেপুটি-মুন্সেফের চেয়ে বড়, তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে স্কুল-মাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে, এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা-এই কথাটি আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে। এইটে বুঝিতে না পারার মূঢ়তাই আমাদের সকলের চেয়ে বড় মূঢ়তা। আমাদের সমাজে এ কথা আমাদিগকে বোঝায় না, আমাদের স্কুলেও এ শিক্ষা নাই’ (রবীন্দ্র রচনাবলি, ১৩৯৮, ত্রয়োদশ খন্ড, লক্ষ্য ও শিক্ষা, পৃ. ৭০০)

সে সময়ের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে কবি ‘কেরানিগিরির কল’ আখ্যা দিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, এ বিদ্যা মানুষকে সৃজনশীল করে না। এতে প্রাণের কোনো গৌরব নেই। ‘এখানে নোটের নুড়ি কুড়াইয়া ডিগ্রির বস্তা বোঝাই করিয়া তুলিতেছে, কিন্তু তাহা জীবনের খাদ্য নহে।’ (ঐ, পৃ. ৬৯৮)

বৃহৎভাবে উদ্যমশীল এক জীবনের জন্য অবশ্যি বিদ্যাকে প্রাণের মধ্যে আয়ত্ব করতে হবে। জীবন চলার পরিপাক শক্তি সেরকম প্রাণস্পর্শী বিদ্যা থেকেই তৈরি হয়। সে-জন্য নিত্যদিনের জীবনচলার প্রকৃতি থেকে বিদ্যার রস সঞ্চারণ করতে হয়। বৃহত্তর মানব সমাজই হতে পারে মানুষের বড় পাঠ্যক্রম।

‘...মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে, যেমন জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া উঠে, প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে। মানুষকে ছাঁটিয়া ফেলিলেই সে তখন আর মানুষ থাকে না-সে তখন আপিস-আদালতের বা কল-কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্রী হইয়া ওঠে; তখনই সে মানুষ না হইয়া মাস্টারমশাই হইতে চায়; তখনই সে আর প্রাণ দিতে পারে না, কেবল পাঠ দিয়া যায়।’ (ঐ, পৃ. ৬৯৮)

ইংরেজরা নিজেদের দেশে এরকমই মানুষ তৈরির শিক্ষা চালু রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রবাসে সে-প্রক্রিয়া ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে প্রায় বছর খানিক ইংল্যান্ডে ছিলেন পড়াশোনার জন্য। তাছাড়াও তিনি পশ্চিমের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সারাজীবনই যোগাযোগ রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...য়ুরোপের ছেলেদের মানুষ করিবার পন্থা আপনা-আপনি পরিবর্তিত হইতেছে। ইহাদের চিত্ত যতই নানা ভাবের জ্ঞানের অভিজ্ঞতার সংস্রবে সচেতন হইয়া উঠিতেছে ততই ইহাদের পথের পরিবর্তন দ্রুত হইতেছে।...চিত্তের গতি-অনুসারেই শিক্ষার পথ নির্দেশ করিতে হয়।...নানা লোকের নানা চেষ্টার সমবায়ে আপনিই সহজ পথটি অঙ্কিত হইতে থাকে। এজন্য সকল জাতির পক্ষেই আপন পরীক্ষার পথ খোলা রাখাই সত্যপথ-আবিষ্কারের একমাত্র পন্থা।’ (ঐ, পৃ. ৬৯৬)

রবীন্দ্রনাথ যে সময় শিক্ষা নিয়ে ভাবছিলেন তখনও শিক্ষাদান পণ্য বিকিকিনির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেনি। তবে সে-রকম প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিপদ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা তার রচনায় খুঁজে পাওয়া যায়। শিক্ষককে গুরুর আসনে বসানোর রবীন্দ্রস্বপ্ন বাস্তবের কষাঘাতে যখন খান খান হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তিনি লিখেছিলেন, ‘...শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তাহার ব্যবসা।

তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনিতে পারে কিন্তু তাহার পণ্য তালিকার মধ্যে সেই শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন-এই খানেই ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ। এইরূপ প্রতিকূল অবস্থাতেও অনেক শিক্ষক দেনাপাওনার সম্বন্ধ ছাড়াইয়া ওঠেন-সে তাহাদের বিশেষ মাহাত্ম্য গুণে।...এই শিক্ষা-দোকানদারির নিচতা হইতে দেশের শিক্ষককে ও ছাত্রগণকে কি আমরা রক্ষা করিব না।’ (রর, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৫৮৩-৮৪)

রবীন্দ্রনাথ যে তপোবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে গুরু-শিষ্য একে অপরের আত্মীয়। শুধু স্বপ্ন কেন, নিজেও তিনি অনেকের কাছে হয়েছিলেন গুরুদেব। শান্তিনিকেতন গড়ে তিনি প্রমাণও করেছিলেন ছাত্র-শিক্ষক হতে পারে একে অপরের পরম আত্মীয়। তাই হয়তো তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘...গুরু-শিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষাকার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মতো চলাচল করিতে পারে। কারণ, শিশুদের পালন ও শিক্ষণের যথার্থ ভার পিতামাতার ওপর। কিন্তু পিতামাতার সে-যোগ্যতা অথবা সুবিধা না থাকাতেই, অন্য উপযুক্ত লোকের সহায়তা অত্যাবশ্যক হইয়া ওঠে। এমন অবস্থায় গুরুকে পিতামাতা না হইলে চলে না।’ (রর, ত্রয়োদশ খণ্ড, শিক্ষাবিধি, পৃ. ৬৯৮)

শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা শৈশব থেকেই। মনুষ্যত্বের জন্য সম্পূর্ণ শিক্ষা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করেন, আকাঙ্ক্ষা , শক্তি, স্বাধীনতা আর নৈতিক যোগাযোগ-এই চারটি শব্দের মধ্য দিয়ে মানুষ সম্পূর্ণ শিক্ষা অর্জন করে বিশ্বজগতের মাঝে স্থান করে নিতে পারে। তাঁর শৈশব এবং শিক্ষা বিষয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৯) একবার লিখেছিলেন, ‘আকাঙ্ক্ষার বাতাবরণে আমি বড় হয়েছিলাম- মনুষ্য প্রবৃত্তি বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা

বাড়িতে মাতৃভাষায় আমাদের শক্তির স্বাধীনতা ছিল, সাহিত্যে কল্পনার স্বাধীনতা ছিল, ধর্মাচরণে আত্মার স্বাধীনতা ছিল আর সামাজিক বাতাবরণে চিত্তের স্বাধীনতা ছিল। এভাবেই শিক্ষার শক্তির ওপর আমার আত্মবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল, যা জীবন তা-ই বাস্তব, শিক্ষা স্বাধীনতার ধারাবহ। মানব জগতের জন্য যা সব থেকে প্রয়োজনীয় তাহলো বিশ্ব জগতের মাঝে নৈতিক যোগাযোগের স্বাধীনতা...’ (‘শিক্ষার আদর্শ’, বিশ্বভারতী ত্রৈমাসিক, এপ্রিল-জুলাই ৭৩-৭৪) ।

শিক্ষার অর্থ সৃষ্টিশীল ভাবনার মুক্তি। কৈশোরে, ষোল বছর বয়ঃক্রমকালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে এই সত্য অনুভব করেছেন। (১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকার শ্রাবণ ১২৮৪ সংখ্যায়) তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টি ছাড়া শিক্ষাপ্রণালি প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল-ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলী মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রুচিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।’

সুশিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে রুচির পক্ষে, মাত্রাজ্ঞানের পক্ষে, নীতি-নৈতিকতার পক্ষে, মূল্যবোধ ও চিন্তার আভিজাত্যের পক্ষে (দাঁড় করায়)।’ তিনি মনে করতেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে এবং কাড়ি কাড়ি বই পড়েই এই মুক্তি অর্জিত হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিন্তার দাসত্ব তৈরি হয়। শিক্ষার নিচে চাপা পড়ে যাওয়া এহেন শিক্ষিত মানুষ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

সুতরাং শিক্ষার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির চর্চা দরকার, মনুষ্যত্ববোধের চর্চা দরকার, ভালোবাসার চর্চা দরকার। জাতি, ধর্ম, গোত্র, শ্রেণি, পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে যদি শান্তিপূর্ণ জীবনাচরণের শক্তি না পাওয়া যায় তবে শিক্ষার সার্থকতা প্রতিপন্ন হয় না। এখন, একবিংশ শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষাভাবনা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি সত্য। শতবর্ষ পূর্বে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজ আশা করিতেছি, এবারে আমরা শিক্ষার নাগপাশ কাটিয়া শিক্ষার মুক্ত অবস্থায় উত্তীর্ণ হইব।

আমরা এতকাল যেখানে নিভৃতে ছিলাম আজ সেখানে সমস্ত জগৎ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, নানা জাতির ইতিহাস তাহার বিচিত্র অধ্যায় উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে, দেশদেশান্তর হইতে যুগযুগান্তরের আলোকতরঙ্গ আমাদের চিন্তাকে নানাদিকে আঘাত করিতেছে-জ্ঞানসামগ্রীর সীমা নাই, ভাবের পণ্য বোঝাই হইয়া উঠিল।’ (‘কালি ও কলম’, ৭ম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, পৃ. ২২৭)

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে আরামদায়ক জীবনের লক্ষ্য হিসেবে মনে করেননি। শিক্ষাকে তিনি ব্যক্তির বুদ্ধি, সংবেদনশীলতা, আধ্যাত্মিকতা এবং শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে স্বকীয় প্রতিভার স্ফুরক হিসাবে উপলব্ধি করেছেন। প্রকৃত শিক্ষা ভাগ্যাহত দুঃখীজনের পীড়া অনুভব করার শক্তি সঞ্চারিত করে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন শিক্ষা ও শিক্ষার্থী সনাতনী জ্ঞান ও জগৎ-সংসারের মূল্যবোধের মধ্যে তফাৎ সৃষ্টি করে না। প্রকৃত শিক্ষা বরং শিক্ষার্থীর মনে-প্রাণে তাঁর সংস্কৃতিবোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। 

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রয়োজন সম্পর্কে যখন বলেছেন তখনই সর্বজনের শিক্ষা এবং সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কোনো একটি বা দুটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেও সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার অভাব যদি থেকে থাকে, তাহলে প্রকৃত শিক্ষার আলো মানুষের হৃদয়ে ও মনে প্রবেশ করতে পারে না। সেজন্যই তিনি বলেছেন, ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞান-চর্চার।’ (‘কালি ও কলম’, ৭ম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, পৃ. ১৭০)

এ প্রসঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথম পরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি এ কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে।’ (রর, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃ. ৫১৯) 

বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় কবি গিয়েছিলেন সেখানকার শিক্ষাবিধি দেখবার জন্য। তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। মাত্র আট বছরের মধ্যে শিক্ষা সমস্ত দেশের মানুষের মনের চেহারা বদলে দিয়েছে। মানুষ ভাষা পেয়েছে, আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েছে। সেখানকার শিক্ষাপ্রণালি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এখানে এসে দেখলুম, এরা শিক্ষাটাকে প্রাণবান করে তুলেছে। তার কারণ এরা সংসারের সীমা থেকে স্কুলের সীমাকে সরিয়ে রাখেনি। এরা পাস করবার কিংবা পন্ডিত করবার জন্য শেখায় না-সর্বতোভাবে মানুষ করবার জন্য শেখায়।

আমাদের দেশে বিদ্যালয় আছে, কিন্তু বিদ্যার চেয়ে বুদ্ধি বড়, সংবাদের চেয়ে শক্তি বড়, পুঁথির পঙ্্ক্তির বোঝার ভারে চিত্তকে চালনা করবার ক্ষমতা আমাদের থাকে না। কতবার চেষ্টা করেছি আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে, কিন্তু দেখতে পাই তাদের মনে কোনো প্রশ্নও নেই। জানতে চাওয়ার সঙ্গে জানতে পাওয়ার যে যোগ আছে সে যোগ ওদের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওরা কোনোদিন জানতে চাইতে শেখেনি- প্রথম থেকেই কেবলই বাঁধা নিয়মে ওদের জানিয়ে দেওয়া হয়, তার পরে সেই শিক্ষিত বিদ্যার পুনরাবৃত্তি করে ওরা পরীক্ষার মার্কা সংগ্রহ করে।’ (‘রাশিয়ার’ চিঠি, রর, দশম খন্ড, পৃ. ৫৭০-৭১)

রাশিয়ার জনহিতকর শিক্ষাব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখে ভারতবর্ষের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষদের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত-ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে (রাশিয়া) সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্য কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম।’ (ঐ, পৃ. ৫৫৫-৫৫৬)

রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছেন তা অনেকটা রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার আদলেই। এ প্রসঙ্গে অনেকটা অতৃপ্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তাহলে ভারী উপকার হত। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি, কী হয়েছে আর কী হতে পারত। ... কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থার সঙ্গে এদের জনসাধারণের অবস্থার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল-এই অল্পকালের মধ্যে দ্রুত বেগে বদলে গেছে-আমরা পড়ে আছি জড়তার পাঁকের মধ্যে আকন্ঠ নিমগ্ন।’ (ঐ, পৃ. ৫৫৬)

শিক্ষাপ্রণালি কেমন হওয়া উচিত-এ প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। কেননা জীবন আর শিক্ষা ভিন্ন ভিন্ন জিনিস নয়। মূলত জীবনচলার জন্য, সুন্দর করে বাঁচার জন্য মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন হয়। শিক্ষা তাই জীবনবিচ্ছিন্ন কোনো প্রস্তাবনা হতে পারে না। ‘...এইজন্য যখন এমনতরো প্রশ্ন শুনি ‘আমরা কী শিখিব-কেমন করিয়া শিখিব-শিক্ষার কোন প্রণালির কোথায় কী ভাবে কাজ করিতেছে’-তখন আমার এই কথা মনে হয় শিক্ষা জিনিসটা তো জীবনের সঙ্গে সংগতিহীন একটা কৃত্রিম জিনিস নহে। আমরা কী হইব এবং কী শিখিব এই দুটি কথা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন। পাত্র যত বড় জল তাহার চেয়ে বেশি ধরে না। (ঐ, পৃ. ৬৯৯)

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকে এমন এক শিক্ষা প্রণালি তৈরি করতে হবে যাতে বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম-সকল ধর্মের সনাতনী শিক্ষার সম্মিলিত মিল রয়েছে এবং যার মাধ্যমে আমরা নতুন পথ অনুসরণ করে নব্য প্রজাতির পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করতে পারব যারা জাতির যথাযথ নেতৃত্ব দানে সক্ষম হবে। কবি বলেছেন, ‘যদি তুমি নিজেকে বিশদ ও সম্পৃক্ত ভাবে না চিনতে পার, তবে অন্যকে নকল করে নতুন ভারতবর্ষ নির্মাণে সমর্থ হবে না। বিস্তারিত অধ্যয়নের মাধ্যমে নতুন ভারতবর্ষ নির্মাণ সম্ভব নতুবা দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করতে সক্ষম হব। জ্ঞান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ (ভারত প্রসঙ্গ ২৪তম খণ্ড সংখ্যা-২, পৃ. ১০৯) 

রবীন্দ্রনাথ যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে পশ্চিমের প্রতিটি দেশ, তাদের সংস্কৃতি ও সমাজ নিজ-নিজ লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে কারণ ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের ওপরেই সেগুলির ভিত প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাজীবনের অপেক্ষায় জীবিকা মাত্র। জীবিকা বা চাকুরি যখন আমাদের অভাব এবং প্রয়োজনভিত্তিক, জীবনের লক্ষ্য সেখানে অধিকতর উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত-পূর্ণতা ও সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে তা সতত প্রয়াসী। প্রকৃত শিক্ষার রাস্তায় চলতে পারলে তা অর্জন করা সম্ভব। সেদিক থেকে দেখলে বড় ধরণের উদ্দেশ্য যেমন উদারতা, স্বাধীনতা এবং সৌজন্যতার সঙ্গে লঘু বা প্রাসঙ্গিক উদ্দেশ্য যেমন চাকুরির সামর্থ, দক্ষতা এবং কারিগরি দক্ষতার প্রভেদ সম্পর্কে আমাদের অবহিত হতে হবে। 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিমী শিক্ষা যখন ভারতবর্ষে আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছিল, সম্ভবত কারোর মনেই তখন সম্পূর্ণ শিক্ষা সম্পর্কে কোন চিন্তার উদয় হয়নি। যে শিক্ষা জানার ক্ষেত্রে এমন এক সুযোগ আনবে যার ফলে মানুষ ও প্রকৃতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, সাহিত্য ও চারুকলার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং মানুষ বিশ্বজগতের মাঝে স্থান পাবে। 

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা আজ আমাদের সমাজ জীবনে কতোটা মানানসই তা বলা মুশকিল। তবে বাজার অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে থেকেও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রের কল্যাণী ভূমিকার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবেই রেখেছে। শিক্ষার সকল সুযোগ তৈরি এবং শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করে এসব রাষ্ট্র বস্তুত মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে মূলধারা পুঁজির অভাব পূরণ করেছে। কেননা শিক্ষার মতো শ্রেষ্ঠ জিনিস খোলা বাজারের ‘হুইম’ বা মতিগতির ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘..আমরা জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিসকে টাকা দিয়া কিনিয়া বা আংশিকভাবে গ্রহণ করিতে পারি না; তাহা স্নেহ ভক্তির দ্বারাই আমরা আত্মসাৎ করিতে পারি; তাহাই মনুষ্যত্বের পাকযন্ত্রের জারকরস, তাহাই জৈব সামগ্রিক জীবনের সঙ্গে সম্মিলিত করিতে পারে। বর্তমান কালে আমাদের দেশের শিক্ষায় সেই গুরুর জীবনই সকলের চেয়ে অত্যাবশ্যক হইয়াছে। ...আমাদের সমাজব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের জীবনকে গতিদান করিবেন; আমাদের শিক্ষাবাব¯হায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমার চিত্তের গতিপথকে বাধামুক্ত করিবেন। যেমন করিয়া হউক, সকল দিকেই আমরা মানুষকে চাই; তাহার পরিবর্তে প্রণালি বটিকা গিলাইয়া কোনো কবিরাজ আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবেন না।’ (রর, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃ. ৬৯৮-৯৯)

লেখা-পড়া শেখা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। জনগণ নিজেরা শক্তি অর্জন করে শিক্ষার সুযোগ আদায় করে নেয়ার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে শাসকচক্রের ওপর সে ধরনের সামাজিক চাপ এখনো সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। অজ্ঞতার কারণে তাদের সে মনের রাস্তাও খোলেনি। সুতরাং যারা সংখ্যায় বিপুল অথচ শক্তিহীন তাদের শক্তিশালী করাই এখন সময়ের দাবি। আর সেজন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা দেবার প্রয়োজন বলে তিনি বরাবরই লিখে গেছেন।

এই শক্তি তাদের দিতে গেলে সকলকে লিখতে-পড়তে দিতে হবে। ধীরে ধীরে অন্যান্য অধিকার সম্বন্ধেও তারা সচেতন হবে। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, প্রয়োজন মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপন; যা করতে পারে শিক্ষা। এই শিক্ষা কেবল উচ্চশিক্ষা নয়, লিখতে পড়তে শেখা। কবিগুরুর ভাষায় ‘..... লিখিতে পড়িতে শিখিয়া মানুষ কী শিখিবে ও কতখানি শিখিবে সেটা পরের কথা, কিন্তু সে যে অন্যের কথা আপনি শুনিবে ও আপনার কথা অন্যকে শোনাইবে, এমনি করিয়া সে যে আপনার মধ্যে বৃহৎ মানুষকে ও বৃহৎ মানুষের মধ্যে আপনাকে পাইবে, তাহার চেতনার অধিকার যে চারিদিকে প্রশস্ত হইয়া যাইবে এইটেই গোড়াকার কথা।’ (রর, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৫২)

এই ‘গোড়াকার’ কথাটি আমাদের নীতি নির্ধারকদের পুরোপুরি বোধগম্য হয়েছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। মুখে আমরা গুণমানের শিক্ষার কথা বলছি। কিন্তু শিক্ষায় ন্যায়নীতি ও মানবিকতার স্পর্শ সেভাবে দিতে পারছি না। তা না হলে একটি শিক্ষালয়ে একজন ‘শিক্ষকে’র অভিলাষে ‘নুসরাতে’র মতো এক ছাত্রীর প্রাণ নিঃশেষ হয় কি করে? অধিকার বিহীন শিক্ষা যে শেষ পর্যন্ত আমাদের উন্নয়নের গতিকে থামিয়ে দিতে পারে সে কথাটি মনে রাখতে হবে।

তাই যখন অধিকারের ক্ষেত্র প্রসারিত হতে থাকবে, তখন উন্নয়ন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘....যে-জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ক্রমশই সে জাতির প্রত্যেক বিভাগের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতা চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব তাদের সকলেই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করবার অধিকার পাচ্ছে। এই জন্যই সেখানে মানুষ ভাবছে কি করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো রবে, রোগের হাত থেকে বাঁচবে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’ (রর, দ্বাদশ খণ্ড- পৃ. ৫৮১)

নিজের সমস্যা সমাধানের নিজস্ব মত ও পথের অনুসন্ধানের এ তাগিদ আমরা বর্তমানে স্পষ্টতঃই ভুলে বসে আছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো একটুও বদলায়নি। উল্টো শিক্ষাব্যবস্থায় যতটুকু গণসম্পৃক্ততা ছিল তাও যেন উবে গেছে। আমরা বিদ্যালয়গুলো কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করছি। শিক্ষক নন মাইনে দেয়া শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছি। মানবিকতা ও সৃজনশীলতা শিক্ষকদের আচার আচরণে খুঁজে পাওয়া ভার। শিক্ষকদের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যে সব কথা বলেছিলেন আজো তা খাটে। 

‘...আমরা যাহাকে স্কুলের শিক্ষক করি তাঁহাকে এমন করিয়া ব্যবহার করি যাহাতে তাঁহার হৃদয়মনের অতি অল্প অংশই কাজে খাটে-ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের সঙ্গে একখানা বেত এবং কতটা পরিমাণ মগজ জুড়িয়া দিলেই স্কুলের শিক্ষক তৈরি করা যাইতে পারে। কিন্তু এই শিক্ষককে যদি গুরুর আসনে বসাইয়া দাও তবে স্বভাবতই তাহার হৃদয়মনের শক্তি সমগ্রভাবে শিষ্যের প্রতি ধাবিত হইবে। অবশ্য, তাহার যাহা সাধ্য তাহার চেয়ে বেশি তিনি দিতে পারিবেন না, কিন্তু তাহার চেয়ে কম দেওয়াও তাহার পক্ষে লজ্জাকর হইবে। একপক্ষ হইতে যথার্থভাবে দাবি না উত্থাপিত হইলে অন্যপক্ষে সম্পূর্ণ শক্তির উদ্বোধন হয় না।’ (রর, ষষ্ঠ খণ্ড, শিক্ষা সমস্যা, পৃ. ৬৮৩)

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনের সেই গভীর চাহিদার, যার কথা রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন, প্রতিফলন সেভাবে নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রাণ দেবার শিক্ষা সুযোগ থেকে জাতি আজ অনেকটাই বঞ্চিত। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক শাসনের ভার নিশ্চিত থাকলেও ত্যাগী শিক্ষক ও উদ্যমী ছাত্রের মহামিলন তো কখনো কখনো ঘটেছিল। ভাষা আন্দোলন তো ছাত্র-শিক্ষকদেরই সৃষ্ট এক মহান জাতীয় সম্পদ।

মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগই ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক। সুদীর্ঘ ন’টি মাস এই মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের সাধারণ মানুষের বুকের কাছেই আশ্রয় পেয়েছেন। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনো জীবনের খুব কাছাকাছি তারা চলে গিয়েছিলেন। দারিদ্র্য নামের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চোখাচোখি হয়েছিলেন। সমাজ সম্পর্কের বাঁকগুলো খুব কাছে থকে ধরতে শুরু করেছিলেন। আশা ছিল মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তারা এই অভিজ্ঞতাকে আরও শানিত করার সুযোগ পাবেন নয়া ধাঁচের শিক্ষালয়ে। ঔপনিবেশিক বস্তাপচা পাঠ্যক্রমের বদলে তারা নিজের চোখে দেখা এদেশের হতভাগ্য মানুষের জীবনচলার সুখ-দুঃখ আশাবেদনার কথাও নতুন করে শিখবেন। নিজের মাটি, লাঙল, শস্য, পানি, সংগঠক, শিক্ষক এক নতুন মাত্রা পাবে নতুন পাঠ্যক্রমে।

সেই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের অসঙ্গতি দূর করার সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের এক নতুন মুক্তিযুদ্ধে তারা শামিল হবেন। ‘আমরা কোথা আছি, কোন দিকে চলিতেছি’ তা স্পষ্ট করে জানা যাবে নতুন করে। তাই ভালো মানের শিক্ষা পাবার আমাদের সেই নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন চালু করেছিলেন। কিন্তু ওই কমিশনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার সময় তিনি পাননি। দুবৃত্তদের আঘাতে খান খান হয়ে যায় আমাদের গুণমানের শিক্ষা স্বপ্ন। কিন্তু তাদের সে আশা আর পূরণ হলো না। বরং পঁচাত্তরের পর আমাদের কোমলমতি শিশুদের ইতিহাস বিকৃত শেখানো হলো।

ফলে দারুণ আশাভঙ্গ ঘটলো জাতীয় জীবনে। নেমে এলো হতাশা। সেই হতাশার জের এখনো বহমান। সর্বগ্রাসী মাদক সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন এখনো আমাদের জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমাদের একটি সুচিন্তিত শিক্ষানীতি আছে। কিন্তু এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগ দেখছি না। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। তাতে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষার সুযোগ কিছুটা বেড়েছে। তবে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা থেকে আমরা এখনো বহুদূরে। অথচ আমাদের রয়েছে বিপুল সংখ্যক উদ্যমী তরুণ-তরুণী তাদের মানবিক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। 

বিপুল এই তারুণ্য শুধু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে, নেতৃত্বের অভাবে হারিয়ে যাবে অবক্ষয়ের রসাতলে? ‘শক্তি যেখানে গতিশীল হইয়া আছে সেখানেই মঙ্গল’ রবীন্দ্রনাথের এই যুক্তিতেই বলা চলে আমাদের জাতীয় সম্পদের এক বিরাট অংশ আজ গতিহীন। সম্ভাবনাময় এই সম্পদ বা তারুণ্যকে যদি সত্যি সত্যি দেশের মঙ্গলে কাজে লাগাতে চাই তাহলে তাদের বলতে হবে কোথায় আমরা তাদের নিয়ে যেতে চাই। তাদের সামনে আশার বাণী স্পষ্ট করতে হবে। নীতি নৈতিকতার বিকাশ শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে। আশাহীন জাতি এক পাও এগোতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ এই আশার কথা বার বার বলেছিলেন। মোটা দাগে আমাদের ভবিষ্যতের রূপরেখা আঁকার কথা বলেছিলেন। নিজস্ব  শক্তি ও সম্পদের আলোকে নিজের চলার পথ স্থির করতে বলেছেন। বলেছেন লোকসংখ্যার কোনো মূল্য নেই যদি না তাদের ‘শক্তিসম্পদে’ পরিণত না করে কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে আশাবাদ জাতিকে বিপদের দিনেও নিঃশঙ্ক চিত্তে এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিয়েছিল তা আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষায় প্রাণের পরশ লাগাতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি প্রাণের এই স্পর্শ দিতে পারি, তাহলে শিক্ষাঙ্গনে মাদকাশক্তি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন নিশ্চয়ই বন্ধ হবে। এ কেমন সমাজে আমরা বাস করছি যেখানে শিক্ষক-ছাত্রী পবিত্র সম্পর্ক আজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? শিক্ষালয়েও আমাদের শিশুরা কেন নিরাপদ নয়? কাউকে না কাউকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। একইসঙ্গে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তনও অপরিহার্য। শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতিকরণ ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য হতে পারে না। শিক্ষার মানোন্নয়ন, উপযুক্ত সংস্কৃতিচর্চা, মানবিকতার বিকাশ, পরমত সহিষ্ণুতার মতো বিষয়াবলি ছাত্র রাজনীতির অংশে পরিণত করার প্রয়োজন রয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের পর এ ধরনের কিছু উদ্যোগ নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা নিচ্ছে। এ ধারা আরও শক্তিশালী হোক সেই প্রত্যাশাই করছি।

আর পরিবর্তনের সেই ধারায় যুক্ত হতে চাইলে আমাদের অবশ্যি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনায় ফিরে যেতে হবে। সেজন্য আমরা আবারো রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনায় ফিরে যেতে চাই। তাঁর কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করে আমাদের বাঁচার পথ, উন্নয়নের কৌশলকে আমাদের মতো করে পুনর্নির্ধারণ করতে পারি। তবে সেরকম বিকল্প পথের সন্ধানের জন্য চাই সত্যিকারের দূরদৃষ্টি স¤পন্ন রাজনৈতিক অঙ্গীকারাবদ্ধ নেতৃত্বের। নিজেদের সন্তানদের নিরাপদে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে, দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে মাদক ও সন্ত্রাস জিইয়ে রেখে, শিক্ষকদের গুরু না ভেবে সামনে নতজানু করে রেখে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা থেকে জনগণের অংশগ্রহণ উঠিয়ে দিয়ে আমলাতন্ত্রের থাবার নিচে ফেলে দিয়ে, আর যাই হোক জীবনঘন মানবসম্পদ সৃষ্টিকারী শিক্ষা এ দেশে নিশ্চিত করা যাবে না। আমি রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যেতে চাই আশার বাণী শোনার জন্য। নিজের ওপর আস্থা হারাবার ভয় থেকে মুক্তি পাবার জন্য।

‘...আমাদের জীবনে সুস্পষ্টতা নাই। আমরা যে কী হইতে পারি, কতদূর আশা করিতে পারি, তাহা বেশ মোটা লাইনে বড় রেখায় দেশের কোথাও আঁকা নাই। আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে। প্রকৃতির গৃহিণীপনায় শক্তির অপব্যয় ঘটিতে পারে না। এই জন্য আশা যেখানে নাই শক্তি সেখান হইতে বিদায় গ্রহণ করে। বিজ্ঞান শাস্ত্রে বলে, চক্ষুষ্মান প্রাণীরা যখন দীর্ঘকাল গুহাবাসী হইয়া থাকে তখন তাহারা দৃষ্টিশক্তি হারায়। আলোক থাকিবে না অথচ দৃষ্টি থাকিবে এই অসঙ্গতি যেমন প্রকৃতি সহিতে পারে না, তেমনি আশা নাই অথচ শক্তি আছে ইহাও প্রকৃতির পক্ষে অসহ্য... আশা করিবার ক্ষেত্র বড় হইলেই মানুষের শক্তিও বড় হইয়া বাড়িয়া ওঠে। শক্তি তখন স্পষ্ট করিয়া পথ দেখিতে পায় এবং জোর করিয়া পা ফেলিয়া চলে।

কোনো সমাজ সকলের চেয়ে বড় জিনিস যাহা মানুষকে দিতে পারে তাহা সকলের চেয়ে বড় আশা। সেই আশার পূর্ণ সফলতা সমাজের প্রত্যেক লোকেই যে পায় তাহা নহে; কিন্তু নিজের গোচরে এবং অগোচরে সেই আশার অভিমুখে সর্বদাই একটা তাগিদ থাকে বলিয়াই প্রত্যেকের শক্তি তাহার নিজের সাধ্যের শেষ পর্যন্ত অগ্রসর হইতে পারে। একটা জাতির পক্ষে সেইটেই সকলের চেয়ে মস্ত কথা।’ (রর, ত্রয়োদশ খণ্ড, লক্ষ্য ও শিক্ষা; পৃ. ৬৯৯)। আর একমাত্র সুশিক্ষাই পারে একটি জাতির সেই আশার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে। গভীরতর ও বিস্তৃত করতে।

তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যি ঢেলে সাজাতে হবে এবং আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার প্রথম দিন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমাদের ইতিহাস নিয়ে এক সময় যে অযথা ধস্তাধস্তি বা কূটবিতর্ক হচ্ছিল তা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। আমাদের রয়েছে এক গর্বিত অতীত, সংগ্রামী বর্তমান, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। আমাদের সন্তানদের তাই স্বদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। দেরিতে হলেও নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় তেমন নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরির একটা ভালো সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী দিনের নাগরিকদের শুধু বই পড়ার মধ্যে এবং পরীক্ষার সীমিত করে ফেললে চলবে না। তাদের মনোজগতেও শিল্প ও সংস্কৃতির সুবাতাস বইয়ে দিতে হবে। সেজন্য তাদের সামনে নেতৃত্বের আদর্শ স্থাপন করতে হবে।

দ্বিতীয়, শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে বেকার তরুণরাই সন্ত্রাসী হবে। তখন আর তার কাছে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো মূল্যই থাকবে না। তাই তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন শিক্ষাখাতে জিডিপির অন্তত চার শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। অথচ আজো আমরা জিডিপি’র দুই শতাংশেরও কম শিক্ষায় ব্যয় করছি।

উপযুক্ত জনশক্তি তৈরি করতে হলে এই বরাদ্দের হার অবশ্যি বাড়াতে হবে। আমাদের টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ব্যাপক হারে বাড়াতেই হবে। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের গবেষণা ও উদ্ভাবনের পূর্ণ সুযোগ উচ্চ শিক্ষালয়ের বাড়তি বাজেটের মাধ্যমে অবশ্যি সৃষ্টি করতে হবে। যে হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও তৈরি না করতে পারলে গণমানের শিক্ষার অভাবে দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেতে পারে। এদিকটায় নীতিনির্ধারকদের নজর পড়বে বলে প্রত্যাশা করছি।

রবীন্দ্রনাথ টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকে জীবনধর্মী, প্রাণস্পর্শী, মানবিক, ন্যায়-ভিত্তিক ও বৈশ্বিক যোগাযোগ ধর্মী করতে বলেছেন। প্রকৃতি ও সমাজ থেকেও শেখার নানা সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। সে রকম সৃজনশীল প্রাণের শিক্ষাই হতে পারে আমাদের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। 


লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

ই-মেইল: [email protected]

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //