‘ভাববা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করতেছ’

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে শিল্পী ধ্রুব এষ-এর স্মৃতিচারণ

‘হুমায়ূন স্যারের কথা আর কী বলবো? কীভাবে বলবো? আমাদের এক সঙ্গে এতো স্মৃতি, এতো কাজ!’- বললেন ধ্রুব এষ। যারা হুমায়ূন পাঠক তাদের কাছে এ নামটির আলাদা একটি অর্থ আছে। হুমায়ূন পাঠকের কাছে ধ্রুব এষ একটা ফ্যান্টাসির গেটওয়ে। হুমায়ূনের বই হাতে নিলে তার প্রচ্ছদ পাঠকের ভেতরে তৈরি করে সেই ফ্যান্টাসির জগতে ঘুরে বেড়ানোর অবারিত তৃষ্ণা। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের ভাষার মতোই তার বইয়ের প্রচ্ছদও প্রাঞ্জল কিন্তু রহস্যময়। হুমায়ূন-ধ্রুব এষ তাই পাঠকের কাছে এক যুগলবন্দি। কেমন ছিলো সে যাত্রা? শুরুটাই বা কীভাবে হলো? 

“স্যারের যে বইয়ের প্রচ্ছদ আমি প্রথম করেছি সেটি ১৯৭১ মঞ্চনাটকের বইটা। আমি তখন ছাত্র, অলরেডি হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ পড়ে মাথা খারাপ হয়ে আছে। প্রকাশক বললেন হুমায়ূনের নাটকের বইয়ের প্রচ্ছদ করতে হবে। আমি দুটো করে ফেললাম। প্রকাশক নিয়ে গেলেন। স্যারের পছন্দ হলো না। আবার দুটো, আবার স্যারের পছন্দ হলো না। এভাবে আটটা প্রচ্ছদ করলাম। স্যারের পছন্দই হলো না। প্রকাশককে বললেন, ছেলেটাকে আসতে বলো। প্রকাশক বললেন, পছন্দ হচ্ছে না, আপনি তারপরেও করবেন এই কাজ? আমি বললাম, আমার যদি একশ’টা প্রচ্ছদও করতে হয়, তারপরেও আমি করবো। এরপর একটা প্রচ্ছদ করলাম। স্যারের সেটা পছন্দ হলো। সেই শুরু।”

আমি উশখুশ করতে থাকি। মনে হতে থাকে আর কিছু বলবেন না ধ্রুব এষ। কথাই যে কম বলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গেলে তিনি নাকি বলতেন, ‘আপনাদের এখন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, যে কোনো কথা বলবে না!’ ১৯৯৪ সালের পর আর বইমেলায় যাননি নন্দিত এই প্রচ্ছদশিল্পী। প্রচ্ছদের কাজ করেন ফেব্রুয়ারির ২৮ পর্যন্ত। কাজটা সমানভাবে নেশা আর পেশা এভাবেই দেখেন। আমার জানতে ইচ্ছা করছিল, হুমায়ূন আহমেদ ধ্রুব এষকে কী নামে ডাকতেন, কেন যেন আমার মনে হলো অন্য কোনো নামে ডাকতেন হয়তো! আমি ভাবতে থাকি, এমন কাজপাগল লোককে কী নামে ডাকতে পারেন হুমায়ূন? 

“স্যার একটা কথা বলেছিলেন আমাকে, খুব গুরুত্বপূর্ণ- বলতেন, ‘আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করার সময় ভাববা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করতেছ।’ এই একটা কথার মানে হলো, সেই যে পুরাতন ধ্যান-ধারণা, উপন্যাসের প্রচ্ছদে একটা মেয়ের মুখ বা একটা চোখ এসব থেকে আমি এক লাফে চলে গেলাম এক্সপেরিমেন্টের দিকে, আইডিয়া বেজড কাজের দিকে। এর আগে স্যার খালিদ হোসাইন, সমরদা- তাদের সাথে এই কাজটা শুরু করে ফেলেছিলেন। কাজ করার জন্য স্যারের এই স্বাধীনতা আমার জন্য ছিলো স্বর্গের চাবি পাওয়ার মতো। মানে, যা ইচ্ছা তা। যে জন্য তার বইয়ের প্রচ্ছদ ছিলো সবচেয়ে আলাদা। স্যার শুধু বলতেন বইয়ের নাম এই, প্রচ্ছদ করো, এভাবে তার প্রায় ২৫০টা বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি।” 

আমার স্বীকার না করে উপায় কী? বড়ই হয়েছি হুমায়ূন পড়ে, তার চরিত্রগুলোর আবছা রূপ-রঙ তো এ শিল্পীরই সৃষ্টি! জানতে চাইলাম হুমায়ূনের সবচেয়ে প্রিয় প্রচ্ছদ কোনটা?

‘ছায়াবীথি, কেন জানি না। তবে এটা তৈরির গল্পটা কেন জানি আমার ভালো লাগে। শীতের শেষে শুকনা বটপাতা নিয়ে আমার এক বন্ধু এলেন বিকালবেলা, বললেন, তুমি তো বহুকিছু বানাও, দেখি এই বটপাতা দিয়ে কী বানাতে পারো। আমি সেগুলো কেটে গাছ বানালাম, একটা মেয়ের ফিগার বানালাম। তখনো কম্পিউটারের যুগ আসেনি। এটি দেখালাম হুমায়ূন ভাইকে, তিনি আমাকে পার্ল পাবলিশার্সের ‘মেনু সাহেব’-এর কাছে প্রচ্ছদ দিয়ে আসতে বললেন, বইয়ের নাম ছায়াবীথি। এটা তো আর ওই অর্থে আঁকা না, বানানো আর কী!” 

আরো অনেক কথা হলো হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে। ধ্রুব এষকে কী নামে ডাকতেন সেটাও উদ্ধার করা গেলো। কিন্তু শিল্পীর সাথে সেই চরিত্রের কোনো মিল নেই- শিল্পীর এমনতর দাবির জন্য তাই নামটা প্রকাশ করা গেলো না! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //