বাংলাচর্চায় ভিনদেশিরা

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে কেবল বাঙালিরা যে সর্বাগ্রে চেষ্টা করেছেন, তেমনটি নয়। বিভিন্ন সময়ে নানা পরিপ্রেক্ষিতে ভিনদেশী মানুষজনও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষে কাজ করেছেন। এরা কেউ কেউ শাসনের সুবিধার্থে অথবা ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে এসে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হয়েছেন, কেউ কেউ আছেন যারা বাংলাকে ভালোবেসে এর চর্চার সঙ্গে মিশে গেছেন। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দু’প্রকারে বাঙালিরাই উপকৃত হয়েছে, নতুন গতি পেয়েছে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। সেজন্য ভিনদেশিদের বাংলাচর্চা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং এই চর্চা ইতিহাস ও অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

প্রথম বাংলা ব্যাকরণের রচয়িতা কে? প্রাজ্ঞজন মাত্রই জানেন প্রথম বাংলা ব্যাকরণের রচয়িতা যিনি, তিনি একজন ইংরেজ। ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড এ ব্যাকরণের প্রণেতা। এই গুণী মানুষটি ১৭৭৮ সালে ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রকাশ করেন। ২১৬ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছিল ৩০ টাকা। এটিই প্রথম গ্রন্থ যেখানে সর্বপ্রথম বাংলা শব্দ মুদ্রিত হয়েছিল। ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও উদাহরণ হিসেবে এতে বাংলা বর্ণমালার বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। এর আগে একজন ছিলেন, ম্যানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও- যিনি বাংলা ভাষাকে নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৪৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলা-পর্তুগিজ শব্দকোষ’ লিবসন থেকে প্রকাশিত হয়।

তিনি এ গ্রন্থে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাংলা ভাষা সম্পর্কে পাঠককে ধারণা দিতে চেষ্টা করেছেন। পরিসর ও গুরুত্ব বিবেচনায় ম্যানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও যে কাজটি অসমাপ্ত রেখেছিলেন-উত্তরসূরি হয়ে হ্যালহেড সেই কাজটি সম্পন্ন করেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, হ্যালহেডই প্রথম ব্যক্তি যিনি পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন এবং প্রথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন। হ্যালহেড যে অনালোকিত নিঃসঙ্গ পথে শেরপার মতো হেঁটেছেন- সেটি তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন এবং গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন- ‘যে পথ কেউ কখনো মাড়ায়নি, সেপথ আমি পরিষ্কার করে হাঁটছি। আমাকে এ পথ ধরেই হেঁটে যেতে হবে। যাতে করে আমি আমার পরবর্তী পথিকের জন্য স্থায়ী পদচিহ্ন রেখে যেতে পারি।’

হ্যালহেড যে আলোকবর্তিকা ছিলেন এবং স্থায়ী পদচিহ্ন রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন- তা এ সময়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলা যায়। নতুবা ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রকাশের প্রায় আড়াইশ’ বছর পর তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ স্মরণ করত না। হ্যালহেডের ব্যাকরণটি নানা কারণে বহুল আলোচিত ও সমাদৃত হয়। এ গ্রন্থটির মধ্যে প্রথম বাংলা ছন্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়। কেবল হ্যালহেড নয়, ব্যাকরণটি প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর বন্ধু চার্লস উইলকিনসের। আরও মজার বিষয় হলো- হয়তো হ্যালহেড এ গ্রন্থটি লিখতেন না- যদি না বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁকে এ কাজে উৎসাহ জোগাতেন। ব্যাকরণ রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল- ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখাতে সহযোগিতা করা। ইংরেজদের বাংলা শেখানো প্রয়োজন পড়ল কেন? এমন প্রশ্নের সহজ অথচ নির্মম উত্তর আমরা জানি- বাংলা শিখতে পারলে বাঙালিদের ওপর আরও ভালোভাবে শাসন ও শোষণ করা সম্ভবপর হবে। ওই অর্থে যদিও ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ রচিত হওয়ার অন্তর্লীন উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসন জোরদার- তবু পরোক্ষভাবে বাংলা ভাষা উপকৃত হয়েছে।

কেননা, পরবর্তীতে যারাই বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে কাজ করেছেন- তারা প্রত্যেকেই কমবেশি হ্যালহেড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এমনকি রাজা রামমোহন রায়ও তাঁর প্রভাব এড়াতে পারেননি। হ্যালহেডের বিশেষত্ব কেবল ব্যাকরণ রচনায় নয়, তাঁর চিন্তাও প্রশংসাযোগ্য। তিনি সেই সময়েই বাংলা ভাষার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার সাযুজ্য খুঁজেছেন এবং পেয়েছেনও। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি টান থেকেই তিনি বাংলা পুঁথি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। তাঁর সংগ্রহে যে ১২টি পুঁথি ছিল তার মধ্যে কালিকামঙ্গলের প্রাচীনতম পুঁথিটিও ছিল। ইংরেজদের মধ্যে প্রথম হ্যালহেডই মনে করতেন, শাসন কার্যের সুবিধা ছাড়াও বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনা হলে মানুষজন ‘সাহিত্য ও বিজ্ঞান’ বিষয়ে সমৃদ্ধ হবে। সে অনুযায়ী অবশ্য তিনি তাঁর যা করণীয় ছিল- করেছেন।
ম্যানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও, হ্যালহেড ছাড়াও বিদেশিদের মধ্যে আরও অনেকে বাংলা ব্যাকরণ রচনায় কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে জিসি হটন, রেভারেন্ড ডব্লিউ ইয়েটস, জে কিথ, জন বিপ্স উল্লেখযোগ্য।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে ব্যক্তির পাশাপাশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি ছিল এর অন্যতম। উইলিয়াম জোনস ছিলেন এ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। মূলত প্রাচ্য সম্পর্কে গবেষণার নিমিত্তে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় পুঁথি ও বই সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে। এ গ্রন্থাগারে বাংলা সাহিত্যেরও বিভিন্ন পুঁথি ও বই সংগৃহীত হয়েছিল। সোসাইটির বিভিন্ন সভায় বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা হতো। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি ইংরেজরা পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে বাঙালিরা সদস্য হওয়ার সুযোগ পায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত প্রমুখরা এ সোসাইটির সদস্য ছিলেন।

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার দেড় দশক পরে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এ কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা গদ্যের বিকাশ তরান্বিত হয় এবং ভাষা ও ব্যাকরণচর্চা গতিশীলতা লাভ করে; কিন্তু এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজও প্রতিষ্ঠা করেছিল নিজেদের স্বার্থে। বাঙালিদের ভালোভাবে শাসন ও শোষণের পথে ইংরেজদের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল বাংলা ভাষা। ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল বাংলা না শিখলে তারা ভালোভাবে শাসন করতে পারবে না। মূলত ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।


ইংরেজদের শাসনের সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠা করা এ কলেজটি শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। এ কলেজে কেবল বাংলাই শেখানো হতো না, গবেষণা, অনুবাদ ও গ্রন্থ প্রকাশসহ কলেজটি বহুবিধ কাজ করত। ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের কাজে দেশি-বিদেশি অসংখ্য আগ্রহী পণ্ডিত, গুণীজন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার বিকাশের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেয়েছিল। এ কলেজে ভালোভাবে এ উপমহাদেশের ভাষাগুলোর চর্চা শুরু হয়। বাংলা বিভাগের চর্চার সঙ্গে যেমন বিদেশিরা জড়িত ছিলেন, তেমনি এদেশীয় গুণীমানুষরা সম্পৃক্ত থেকে বাংলাচর্চা ও গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

উইলিয়াম কেরি ছিলেন এ বিভাগের প্রধান। তিনি আগ্রহভরে বাংলা শিখেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার; কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যুক্ত হয়ে তিনি বাংলাকে যেমন ব্যাকরণ ও গ্রন্থ রচনায় কাজে লাগান, তেমনি বাংলায় বাইবেল অনুবাদও করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলা ভাষার উৎকর্ষে কাজ করে গেছেন। জন বোর্থউইক গিলক্রিস্ট, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, তারিণীচরণ মিত্র প্রমুখদের কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারকে বাংলা গদ্যের সচেতন শিল্পী বলা হয়ে থাকে, তিনি সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত হয়েও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতেন। ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘হিতোপদেশ’সহ তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। বিদেশি ও বাঙালিদের প্রচেষ্টায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভাষাচর্চায় যে বিশেষ গতি এনেছিল- তা পরবর্তী কয়েক দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস- তারও সূচনা করেছিল ইংরেজরা। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িকপত্র ‘দিকদর্শন’। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত এ পত্রিকায় ভূগোল, ইতিহাস, কৌতুক, তথ্যবহুল বিভিন্ন লেখা থাকত। দিকদর্শন প্রকাশিত হওয়ার একমাস পরে একই সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। ১৮৪১ সাল পর্যন্ত এ পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। তাই বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ ও বিকাশে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি বিদেশি হয়েও প্রথম বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনা করেন। অনেক গবেষকরা মনে করেন হানার লেখা ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ই হলো বাংলায় রচিত প্রথম উপন্যাস। এটি ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও হানা ক্যাথেরিন মুলেন্সের বাংলা শেখার ইতিহাস ভিন্ন ও ধর্মঘনিষ্ঠ। হানার পিতা ফ্রাঁসোয়া ল্যাক্রোইক্স পেশায় পাদ্রি ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন। হানা বাড়ির কর্মচারীদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে বাংলা শেখেন। হানাও যে তাঁর পিতার ধর্ম প্রচারের কাজে সহযোগিতা করতেন তা বলাই বাহুল্য। বাংলা আত্মস্থ করার ফলে হানা বাঙালি জীবনযাপনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি লেখেন ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’। উপন্যাসে বাঙালি খ্রিস্টান মহিলাদের সময়, দুঃখ, প্রেম ও দ্বন্দ্বকে কাঁচা হাতে এঁকেছেন তিনি। যদিও এটি যথার্থ উপন্যাস নয়, এবং প্লটও মৌলিক নয়, ইংরেজি একটি গল্প থেকে ধার করা- তবু প্রথম প্রয়াস হিসেবে এটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ১৮৫৮ সালে প্যারিচাঁদ মিত্র ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লেখেন। স্বার্থক বিবেচনায় এটিকে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। আবার অনেক গবেষক মনে করেন ১৮২৫ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘নববাবুবিলাস’ প্রথম উপন্যাস। বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস বা প্রথম স্বার্থক উপন্যাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্সই প্রথম বিদেশি, একজন সুইস নারী- যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস লিখেছেন। হানা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যাঁরা হৃদয়ে ধারণ করেছেন তাঁদের মধ্যে ফাদার দ্যতিয়েন অন্যতম। তিনিও ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে। তার জন্ম বেলজিয়ামে, পল দ্যতিয়েন তাঁর আসল নাম এবং তিনি ফরাসিভাষী। এ উপমহাদেশে এসে তিনি বাংলাকে ভালোভাবে আত্মস্থ করেন। যার ফলে তিনি বাংলা ভাষাভাষীর মতোই বাংলায় কথা বলতে ও স্বাচ্ছন্দ্যে লিখতে পারতেন। তাঁর সাহিত্যমনষ্কতার কথা উপমহাদেশব্যাপী বিধৃত। বাংলা সাহিত্য পড়তে পড়তেই তিনি সাহিত্য রচনার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এ কথা তিনি তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেনও। তিনি ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় ‘ডায়েরির ছেঁড়া খাতা’ শিরোনামে গদ্য লিখতে শুরু করেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একই শিরোনামে তিনি দেশ পত্রিকায় লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। কেবল লেখা নয়, ডায়েরি ছেঁড়া পাতার জন্য তিনি পুরস্কারও পেয়েছেন। দিল্লি বিশ^বিদ্যালয় থেকে ‘নরসিংহ দাস’ পুরস্কারে ভূষিত হন। তাছাড়া ১৯৭৭ সালে বেলজিয়াম সরকার বিদেশের মাটিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উৎকর্ষ সাধনের জন্য তাঁকে ‘ক্রিস্তফ প্লানতিন’ পুরস্কারে ভূষিত করে।

রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর খুব প্রিয় ছিল। মজার বিষয় হলো পল দ্যতিয়েন শান্তি নিকেতনে বাংলা এমএ পড়তে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘পরম্পরা’, ‘আটপৌরে দিনপঞ্জি’, ‘রোজনামচা’- গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে ভিন্ন রকম গদ্যস্বাদের আবাহন করতে সুযোগ করে দিয়েছিল। ফাদার দ্যতিয়ান বাংলা সাহিত্যচর্চায় বিদেশি হয়ে যতটা সফল ও পাঠক ভালোবাসা পেয়েছেন- অন্য কেউ তেমনটি পেয়েছিলেন কি-না, সন্দেহ রয়েছে। ১৯৫০ সালে এ উপমহাদেশে এসে প্রায় তিন দশক অতিক্রান্ত করে তিনি ১৯৭৮ সালে নিজ বাসভূম বেলজিয়ামে ফিরে যান। তারপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশে আসেননি তিনি। ২০১৫ সালে অমর একুশে বইমেলায় তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঢাকায় আসেন। এতদিন পরে এলেও বাংলা ভাষাকে তিনি ঠিকই ভোলেননি। অতিথির বক্তব্যে তিনি চমৎকার বাংলা বলে সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল বেলজিয়ামে বাংলা ভাষাচর্চা কেন্দ্র করবেন। বাংলা সাহিত্যকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও ফাদার দ্যতিয়ান প্রবল আগ্রহী ছিলেন।

২০১৫ সালের ৩১ মে বেলজিয়ামে বাংলাভাষার এ সুহৃদ ৯২ বছর বয়সে মারা যান। তিনি তাঁর পরিবারকে বলে রেখেছিলেন, তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যেন ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি বাজানো হয়। তাঁর অন্তিম ইচ্ছার কথা বারবার জানান দেয় যে, ফাদার দ্যতিয়েন আমাদের লোক ছিলেন, তিনি বাংলাকে ভালোবাসতেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //