মালার্মে, পবিত্রতার কবি

স্তেফান মালার্মে ফরাসি কবিতা রাজ্যে ভিন্ন ধরনের সুর আনয়নকারী। তিনি তাঁর জীবৎকালে খুব বেশি কবিতা লেখেননি। তাঁর সমসাময়িক ছিলেন ভেরলেন। আর দেড় দশক পরে ব্যাঁবো। ফরাসি কবিতায় ঝড় উঠল, নড়ে চড়ে বসেছে কাব্যবোদ্ধাদের জগৎ; কিন্তু মালার্মের কবিতা বিপরীতমুখী, বিপরীত ধারার। স্বভাবে অনেক শান্ত, ধীর আর স্থির। পাপ পুণ্য নিয়ে তাঁর মনোজগত। মালার্মের কবি স্বীকৃতির চেয়ে বেশি পছন্দ ছিল কবিতার দার্শনিক শব্দে। শেষজীবনে কবিতা লেখা ছেড়েছিলেন, মন দেন কাব্যতত্ত্ব লেখায়। আবার সেটিও ছেড়ে গানের লিরিক রচনায় মন দেবেন ভেবেছিলেন। গানের নগ্নতম ও শুদ্ধতম প্রতীকী ব্যঞ্জনার কথায় তাঁর ভাবটিকে চেয়েছিলেন ব্যক্ত করতে। এ জন্যই তাঁর কবিতা দুর্ভেদ্য এবং দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠকেরা মালার্মের কবিতাকে মেনে নিতে পারেননি, তবে তরুণ কবিদের জগতে তাঁর কবিতার প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় সে সময়। ভেরলেন ও মালার্মের ভাবনার গতি ভিন্ন হলেও তৎকালীন শাশ্বত ভাবনা থেকে তারা আলাদা হয়ে কবিতার রূপ বদল করেন। বিদ্রোহ করেছিলেন তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য ও চিন্তাধারাকে। মালার্মে চেয়েছিলেন পূর্বসূরি থেকে আলাদা হতে। যদিও তাঁর কবিতায় শার্ল বোদলেয়ারের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

আর পল ভালেরি মালার্মেকে গুরু মেনেছিলেন। সে সময়ে চতুর্দিকে মালার্মের দুর্নাম। সেইসব দুর্নামকে মালার্মে তেমন আমলে নিতেন না। একবার পল ভালেরি মালার্মেকে বলেছিলেন- ‘একদল আপনাকে নিন্দে করে, বিদ্রুপ করে। আপনার নীরবতার কারণে সাংবাদিকরা মজা করে, ঠাট্টা করে। আপনার বন্ধুরা কীইবা করতে পারে? দুঃখে সহানুভূতিতে মাথা নাড়ে; কিন্তু আপনি জানেন ফ্রান্সের প্রতিটি শহরে আপনার কবিতার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত যুবকরা। ফ্রান্সের কবিতার গৌরব বলে মনে করে...।’ এর উত্তর কীইবা দেবেন মালার্মে। অন্যদিকে পল ভালেরি দেখেছেন- সর্ব শক্তিমান হিসেবে, তাঁর চিন্তায় সবসময় মালার্মে। তাঁকে মনীষী বলেও মানতেন। মালার্মে তাঁর কবিতায় কী গুরুত্ব পেয়েছে, তা বোঝা যায় এই স্বীকৃতিতে- ‘তা কতখানি ঠিক তাঁর নিজের ও কতখানি মালার্মের দান।’ তিনি মালার্মের প্রভাবে বিশ্বকে দিতে পেরেছেন এক সৌন্দর্য-তত্ত্ব। মালার্মে কবিতার পরিবর্তনই শুধু করেননি করেছেন রূপান্তরও। ভালেরি একে বলেছেন ‘মৌলিকত্ব’।

এ ছাড়া মালার্মে তাঁর কবিতায় কতগুলো গুণকে শৃঙ্খলিত করলেন যাকে বলা যায় ‘একতা’। তিনি পেলেন একটি ভঙ্গী, যা অকল্পনীয় ছিল তৎকালীন সাহিত্য জগতে। এতে তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেল, বলা যায় সমসাময়িক ও পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন। তাঁর চেষ্টা ছিল নতুন তত্ত্ব গড়া। ভালেরি মনে করেছিলেন, এই নতুন রীতিতে ছিল মালার্মের শৃঙ্খলা এবং সর্বগ্রাসী প্রেম। কবিতা যেন নতজানু হয় একমাত্র কবির দয়ার কাছে। যা কবিকে দিয়েছে ঈপ্সিত ধন এবং শৃঙ্খলা। এতে ঘটে গেল সমস্ত কবিতার ঐতিহ্যের নাড়ির বিচ্ছেদ। শুধু তাই নয়, ঘটল সহজ প্রয়াসের অবসান, যেহেতু তা কবির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে ও আয়ত্তাধীন, ফলে কবির দুরূহ সাধনার ছায়াও যে ছায়া- তাকেও দুরূহ করে তোলে। এসব পাঠের জন্য কবি সবসময় দাবি করে পাঠকের শ্রম। একবার যে মালার্মের কবিতার স্বাদ নিতে পারবে তার কাছে অন্য কবিতা লাগবে পানসে, বিস্বাদ, দুর্বল। এই ভাবনা পল ভালেরি ওঁর কবিতা সম্পর্কে রাখেন।

তিনি এ ব্যাপারে পাঠকের মনে প্রশ্ন তুলেছেন- কবিতা তো জন্ম নেয় মনে। সে ভাবনা মন থেকে যখন বেরোয় তা আকার পায় সাদা পৃষ্ঠায়, একরকম ছিটকে বেরোয়, ঝাঁকুনি লাগে অকস্মাৎ। এ যেন দুর্ঘটনার মতো, অদৃশ্য শূন্য হতে হঠাৎ কালের দৃষ্টিতে তরঙ্গিত প্রবাহে, প্রবাহিনীর মতো। মালার্মে যেন অমানুষিক শৃঙ্খলার স্রষ্টার প্রতিমূর্তি। মুক্তিদাতা ঋষি। পল ভালেরিকে মনেই হতে পারে আবেগে আচ্ছন্ন। সত্যি কী তাই! তাঁর কবিতায় দেখা যায় ত্যাগের দূরদর্শিতা, সস্তা প্রলোভন বর্জনের মত্ততায় তা প্রাণ পেতে চেয়েছে। বিস্ময়কর এই তাঁর পরিমিতিবোধ। ভালেরি মনে করেন, নীতির একটি অপরিমেয় মর্যাদাই হলো শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। কারণ, এ নিয়ে অনিবার্য অন্তর্দ্বন্দ্বে সব স্রষ্টাকে ভুগতে হয়। ‘যদি লিখতেই হয়, বরং লিখব সম্পূর্ণ সজ্ঞানে ও নিজের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে, প্রাণচঞ্চলতায়- হোক না সে লেখা দুর্বল, তুচ্ছ।’

যে কথা অবশ্যই মেনেছেন, তা হলো ধ্বনি যা মালার্মের সারাজীবনের সাধনা। শৃঙ্খলার দ্যোতনা। নতুন অর্থ দিলেন, শিল্প বিচিত্র বিশে^র স্পন্দনে প্রাণ পেতে চাইছে। লেখা মানে, জাগরণ উত্থিত সাধনার শেষ সিদ্ধি হলো- সাদা কাগজের ওপর ফুঠে ওঠা মননের প্রতিচ্ছবি। মালার্মের সাহিত্যতত্ত্ব। যেমন করে খাল বিল নদীর জল শুনেছে বহুদূর সমুদ্রের আহ্বান, তেমনি মানুষের প্রয়াস পেতে চায় তার শেষ ও পরম প্রকাশ একটি ‘বই’-এ। তিনি পূজারি ছিলেন বইয়ের এবং কল্পনার। তিনি বইকে দেখতেন শুদ্ধতার প্রতীক, তাঁর কবিতাও যেন তাই। তিনি শিল্পের চর্চায় তা করেছেন আজীবন। শুধু তাই পবিত্রতা ও সুন্দরের চর্চায়- মালার্মে আজও অমর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //