রাজনীতির অন্তরালের গল্প

ছবিটি শুরু হয় তথ্যচিত্রের ধরনে। মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার বিরোধী শতকরা সত্তর জনকে প্রশ্ন করা হয়- তারা কখনো কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুষ্ঠান দেখেছেন কিনা? আর তারপর কিছু নিখুঁত বর্ণনা, মৃত্যুদণ্ডের জায়গা, ফাঁসির আগের নানা অনুষ্ঠান প্রার্থনা, ভোজ- ফাঁসির মঞ্চ, গলা ঘিরে দড়ির ফাঁস, অপেক্ষা, বোতাম টেপা, পায়ের তলায় পাটাতন সরে যাওয়া, শরীর ঝুলে পড়া, চিকিৎসকের অপেক্ষা, নির্দিষ্ট সময় পর পরীক্ষা করে মৃত্যুটি নিশ্চিত ঘোষণা- ছবি এখানে এসেই মোড় ঘুরে যায়। গলার ওপর ফাঁসির দড়ির গাঁট চেপে বসার দীর্ঘ সময়ের পরেও একটি শরীর ফাঁসির আসামির শরীর যার নাম ‘আর’- তার নাড়ির স্পন্দন স্তব্ধ হচ্ছে না। বড় বেশি অনিয়ম এটা। বস্তুত এটাই এক ধরনের বিদ্রোহ- প্রাতিষ্ঠানিক কর্তা ব্যক্তিদের কাছে যার ভালো নাম বেয়াড়াপনা।

ওশিমা এমন একটি চরিত্রকে নায়ক করেছেন আপাতঃদৃষ্টিতে যার সম্পর্কে কোনোরকম সহানুভূতি আসা একেবারেই অসম্ভব। খুব সাধারণ নির্ভরতা জীবন আমাদের, আমরা যারা ওই শতকরা সত্তর জন বা বাকি তিরিশ জন, সকলেই। আমরা নিয়ম মানি, খেতে দিলে খাই, পরতে দিলে পরি, শুতে বললে শুই, দাঁড় করালে দাঁড়াই সেখানে এক কোথাকার ‘আর’ নিয়ম মানে না, কথা শোনে না- ধর্ষণ করে দুটি মেয়েকে, তাদের হত্যা করে, অবশ্য সে কোরিয়ান। ‘অপরাধ’ করাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক- এমন লোককে খুব তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়া দরকার- ফাঁসিটাই বেশ উপযুক্ত পদ্ধতি; সুতরাং ‘আর’ কে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়। তারপর...পরিচালক ওশিমা বড় ঝামেলায় ফেলেন আমাদেরও। 

ওশিমা এমন একটি চরিত্রকে নায়ক করেছেন আপাতঃদৃষ্টিতে যার সম্পর্কে কোনোরকম সহানুভূতি আসা একেবারেই অসম্ভব। খুব সাধারণ নির্ভরতা জীবন আমাদের, যারা ওই শতকরা সত্তর জন বা বাকি তিরিশ জন, সকলেই। আমরা নিয়ম মানি, খেতে দিলে খাই, পরতে দিলে পরি, শুতে বললে শুই, দাঁড় করালে দাঁড়াই সেখানে এক কোথাকার ‘আর’ নিয়ম মানে না, কথা শোনে না- ধর্ষণ করে দুটি মেয়েকে, তাদের হত্যা করে, অবশ্য সে কোরিয়ান

চলচ্চিত্র: ডেথ বাই হ্যাংগিং (১৯৮৬), ভাষা: জাপানি, পরিচালক: নাগিশা ওশিমা


ফাঁসিটা হয়ে যেত, আমরা দর্শকরা ‘পাপের বেতন মৃত্যু’ আওড়াতে আওড়াতে বাড়ি ফিরতাম, আমাদের সুখি তা নয়, ‘আর’-এর শরীর মরল না, শুধু শরীরই কেননা পুরোহিত-এর মতে ‘আর’-এর আত্মা এখানে নেই- তাও মন্দ নয়, ব্যাপারটা বেশ মজার- তারপর ‘আর’-এর অ্যামনেশিয়া তাকে তার কৃতকর্মের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য নানা চেষ্টা- কেননা জাপানি সংবিধান অনুসারে ‘অ-চেতন’ কোন ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া যায় না, সুতরাং সিকিউরিটি গার্ড, এক্সিকিউশন অফিসার, এডুকেশন অফিসার, ডাক্তার, পুরোহিত- প্রত্যেকে অভিনয় করে ‘আর’-এর আসল অবস্থানটা তাকে মনে করিয়ে দিতে চায়- মজা, অনেক মজা, সিকিউরিটি গার্ড এর মাথায় ফিতে বেঁধে বোন সাজায় মজা, শর্ট পরে ডাক্তারের ভাই সাজায় মজা, অভিনয়ের মারামারিতে মজা, হাত-তালি দিয়ে গান করায় মজা- আর তারই মাঝে মনে করিয়ে দেওয়া হয় ব্যাপারটা আর একটু ‘ভালগার’ করা দরকার, মানে আর একটু কোরিয়ানদের মতো। 

মুহূর্তেই ওশিমা এই মজা টেনে বার করেন আমাদের- জাতিবিদ্বেষের এই ছোট্ট ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দেন এই হলো জাপানি পুঁজিবাদের বা যে কোনো পুঁজিবাদেরই ধরন- উদিত সূর্যের নিপ্পনী পতাকাবাহী ছাড়া আর সবাইকেই যেখানে মনে করা হয় মানবতের কিছু আর আমাদেরও মনে পড়ে এই মজা এই অভিনয়, সবটাই শুধু ‘আর’-এর চেতনা ফিরিয়ে এনে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য কেননা ‘আর’ দুটি মেয়ে ধর্ষণ করেছে, হত্যা করেছে।

এরই মাঝে ‘আর’-এর ছোট বোন মানে সিকিউরিটি গার্ড বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। ‘আর’-হাত ধরে তাদের বেড়াতে নিয়ে যায়, ফাঁসির চেম্বারের ছোট্ট চার দেয়ালে ঘেরা এলাকার মধ্যে ‘আর’ ঘুরে বেড়ায় মনে মনে, বহু দূরের ষ্টেশনে, পার্কে, রাস্তায়। ‘আর’ তাহলে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখত। তার চোখ গভীর হয়ে আসে, গলা জড়ানো- স্বপ্নের মধ্যে তার শিথিল পদচারণা, বাস্তব সম্পর্কে উদাসীন- আসলে ওশিমা আমাদের জানিয়ে দেন যে বাস্তব স্বপ্নের তীব্র দ্বন্দ্বেই ‘আর’ হত্যাকারী হয়ে ওঠে।

আসলে ‘ ডেথ বাই হ্যাংগিং’ স্বপ্নভঙ্গের নিষ্ঠুরতাকে ধরতে চেয়েছে। গোটা ছবিই একরকম ‘অ্যাবসার্ড’ জগৎ তৈরি করেছে- ফাঁসির পরেও বেঁচে থাকার ‘অ্যাবসার্ডিটি’ থেকেই যার শুরু। আসলে এই সমাজে ‘আর’দের বেঁচে থাকাটাই কি চরম অ্যাব-সার্ডিটি নয়। ‘আর’- এরা এখানে বাঁচে না, কেন না ‘আর’-এরা দরিদ্র, ‘আর’-এরা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বলি, ‘আর’-এরা কোরিয়ান। জাপানে ‘আর’ কোরিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘আর’ নিগ্রো, হিটলারের জার্মানিতে ‘আর’ ইহুদি, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বা লাতিন আমেরিকায় ‘আর’ লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ। এই মানুষগুলোর কাছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদানও স্বপ্নমাত্র। 

‘আর’ সেই স্বপ্নকে ধরতে চেয়েছিল, জীবনের স্বাভাবিক কামনাকে মেটাতে চেয়েছিল; কিন্তু সে কোরিয়ান, সুতরাং, স্বপ্ন তার কাছে স্বপ্নই- বাস্তব নয়। মেরুপ্রমাণ এই দূরত্বের ফলেই তার স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে হয়ে ওঠে তির্যক- ওশিমা তার কৃত ধর্ষণ ও হত্যাকে দাঁড় করান বহু বছরের অত্যাচারের প্রতিবাদ হিসাবে- জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ হিসেবে। ‘আর’-এর সামনে তার আসল অবস্থানটা অভিনয় করতে গিয়ে তাকে আর একটু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, বাইরে খোলা জায়গায়। সত্যি কি খোলা জায়গা। অদ্ভুত একটা আলো- আঁধারিতে এই দৃশ্যগুলো তোলা, মাঝে মাঝেই অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া অবয়ব- এই বহির্দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কেও সংশয় জাগায়। কল্পনা ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের টানাপড়েন, সংযোগ ও সংঘাত ছবির দৃশ্য-পরিকল্পনাতেও এসে যায়। 

একটু মেনে নিতে অসুবিধা হয় ব্যাপারটা, সাধারণ নিশ্চিন্ত বুদ্ধিতে- কিন্তু কে না জানে ন্যায়নীতি, ধর্মাধর্ম, অন্যায়, অপরাধ সবই আপেক্ষিক- শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর তা নির্ভরশীল। ওশিমা হাত দিয়েছেন বড় শক্ত জায়গায়, তুলেছেন বড় অস্বস্তিকর প্রশ্ন। ওশিমা ছবিতে যে বাস্তব-অবাস্তবের জাল বুনেছেন, তারই সঙ্গে মানানসই সমস্ত গল্প। সরু তুলিতে আঁকা জাপানি ছবি। এই রঙ, রেখা, মায়ার জগৎ ওশিমা তৈরি করেছেন। ছবিটির পরতে পরতে উন্মোচিত হয় একটা নিষ্ঠুর সমাজের নিদারুণ সত্য- ওশিমা বস্তুজগতের কঠিন কাঠামো থেকে সরে এসে অবাস্তবতার কাঠামোতে বসিয়ে দেন বস্তুজগতের নিষ্ঠুর সত্যকে। ফলে যে ছবি শুরু হয়েছিল মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে, সে ছবি এভাবে পৌঁছে যায়, গভীর রাজনৈতিক সমস্যায়। ফাঁসির অনুষ্ঠানকে সম্পূর্ণ করার জন্য যাঁরা হাজির ছিল, তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন হত্যার অংশীদার, সেখানে বিচারসিন্ধ হত্যারও কোন যৌক্তিকতা থাকে না। 

ওশিমা এভাবেই তুলে ধরেন শ্রেণিসমাজের প্রবহমান হত্যাধারাকে। ওশিমা পৌঁছে যান শ্রেণিবিভক্ত সমাজের আসল চেহারায়- শেষপর্যন্ত এ ছবি একটা রাজনৈতিক ছবিই হয়ে দাঁড়ায়। যা প্রতিদিন দেশে দেশে ঘটে চলেছে অবিরাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //