হেনা সুলতানা
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৫:০৪ পিএম
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৫:২৬ পিএম
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৫:০৪ পিএম
হেনা সুলতানা
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৫:২৬ পিএম
হঠাৎ ঈশান কোনের মেঘপুঞ্জ অন্ধবেগে বাধাবন্ধনহারা প্রাণ-ভরা ঝড়ের মতোন ঊর্ধবেগে অনন্ত আকাশে ছুটে আসে তখনই ভেতরটা নাড়া দিয়ে হাহাকার করে উঠে, বৎসর শেষ!
দিনের শেষে চৈত্রের অবসানে গাইতে বসি বিদ্যুত চমকের তালে তালে পুরাতন বছর শেষের গান। সে গান শেষ হতে না হতেই ধুলোপায়ে সেই দুর মেঠোপথ মাড়িয়ে, ঝোড়ো হাওয়ায় গুটি আমের গড়াগড়ি পেরিয়ে, শুকনো পাতার হাওয়া উড়িয়ে- বাঁকা পথের শেষে ধুধু-মাঠ যেথা মেঘে মেশে, সে পথ পাড়ি দিয়ে বৈশাখ এলো আমাদের আঙিনায়। জুড়াবো বক্ষ, করবো আলিঙ্গন। উপায় কোথায়? তোমার আমার একত্র সে যাত্রা, এখন যে বড় ভয়ংকর। ‘এ দুর্দিনে কী কারণে পড়িল তোমার মনে বসন্তের বিস্মৃত কাহিনী?’
না, দুর্দিন বা সুদিন নয় ইতিহাসের একটা পর্যায় থেকে এই ভূখন্ডের জনগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখকে তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণার দিন হিসেবেই ধরে নিয়েছে। প্রতি বছর বাঙালি জাতি জন্মায় পহেলা বৈশাখের মধ্য দিয়ে। চির নতুনের প্রতীক হয়ে প্রতি বছর আসবে পহেলা বৈশাখ। তাই তাকে বরণ করতেই হয়।
কী পোড়া দেশ বলো, বৈশাখ এলেই আমাদের পেয়ে বসে রবীন্দ্রনাথে, না কি রবীন্দ্রনাথকে বৈশাখে! সে যাই বলি, উনি ছাড়া বৈশাখ পালন করিই বা কী করে! এই মরন-মারিতে তিনি কী লকডাউনে? সে কী করে হবে? তাঁকে ফ্রেমবন্দি বা আর কোন কিছু দিয়ে বন্দি করা সম্ভব নয়। তিনি যে চিরনুতন! চিরমুক্ত! সেই চিরনূতনকে সাথে নিয়ে আমাদের পথ চলা। তিনি ভাবতে শিখিয়ে ছিলেন মানুষ এই বিশ্বচরাচরেরই অংশ। তাঁর সাহিত্যে, গানে, নাটকে, জীবনাচরণে মেলবন্ধনের কথা বলেছেন মানুষের সাথে প্রকৃতি থেকে শুরু করে সমস্ত প্রাণীজগতের সঙ্গে। সেই জন্যই রবীন্দ্রনাথ চিরকালীন।
শান্তিনিকেতন বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বাংলা সংস্কৃতিতে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কবীহিন একটি সর্বজনীন উৎসব এই নববর্ষ। ৩১শে চৈত্র সন্ধ্যায় সর্বশেষ মন্দিরের পর ১লা বৈশাখ কবিকণ্ঠের মাধ্যমে বর্ষরঙের সূচনা। ( ২০০৪ সালের আগে পর্যন্ত ১লা বৈশাখে রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালিত হতো)
সকালে মন্দিরে উপাসনা। উপাসনা শেষে উত্তরায়নে কবিকক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হয়। সে দিন সকালে অশ্রম বাসীদের জলযোগের ব্যবস্থা থাকে। গৌরপ্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্ম (ইংরেজি ১৮৬১ ৭মে)। আর তিনি ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে বসবাস করতে শুরু করেন। সেই সময় থেকেই শান্তিনিকেতন মহাসমারহে রবীন্দ্রজন্মোৎসবে মুখর হয়ে ওঠে। এ উপলক্ষে ২৫ শে বৈশাখ সকালে মন্দিরে উপাসনায় ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সকলে মিলে উৎসব পালন করেন। প্রারম্ভিক পর্ব শুরু হয় উপনিষদের স্তোত্র দিয়ে তারপর রবীন্দ্র-ভবনে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে কবিকন্ঠের গান ও কবিতা শোনানো হয়। সে দিন সন্ধ্যায় কবি রচিত কোন নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মোৎসব শান্তিনিকেতনে উদয়ন বড়িতে পালন করা হয়েছিল। তাঁর শেষ জন্মোউৎসবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ সম্বন্ধে একটি লিখিত ভাষণ পুস্তিকা আকারে বিতরণ করা হয়েছিল। নববর্ষে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে সমবেত আশ্রমবাসী ও অতিথিদের সমক্ষে কবির উপস্থিতিতে ক্ষিতিমোহন সেন এই প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সত্যদ্রষ্টা কবির বাস্তব জীবন-অভিজ্ঞতার শেষ স্বাক্ষর বহন করছে এই প্রবন্ধটি।
নববর্ষের জন্য কবি রচনা করেছিলেন একটি গান ‘ঐ মহামানব আসে’ । ধরে নিতে পারি এ গান তিনি চৈত্রেই তৈরী করে ছিলেন। ‘সভ্যতার সংকট’ রচনার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে।
যে চৈত্রে তিনি এমন দুটি রচনা সৃষ্টি করলেন সে চৈত্র ছিল বড় নিষ্ঠুর। চারিদিকে অবিশ্বাস। এমন কি জীবন ধারণের একটা ন্যূনতম চাহিদাকেও ঘোরতর অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষ। আশি বছর বয়স অতিক্রান্ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কবি সমগ্র মানবজাতির জীবনে দেখেছেন সভ্যততার সংকট। তিনি এই সংকটে স্বভাবতই বিচলিত ও ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই সভ্যতার সংকট সৃস্টি করেছিল সা¤্রজ্যবাদী শাসকের কালো হাত। অথচ এই রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়সে যখন ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, সেখানকার পার্লামেন্টে তিনি শুনে ছিলেন জন ব্র্ইাটের বক্তৃতা। তাঁর সামনে খুলে গিয়ে ছিল এক নতুন আকাশ। সেই বক্তৃতার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন চিরকালীন ইংরেজের বাণী। ‘সেই বাণী মানবতার। সেই বাণী উদারতার। সেই বাণীর মধ্যে কোথাও জাতিগত সংকীর্ণতা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নিজের আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করার ঔদার্য ছিল সেই বাণীর মধ্যে। আর শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্রেই যে শুধু ইংরেজরা আবিষ্কার করে ছিল তা নয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন উদার মানবতার বাণী।’ রবীন্দ্রনাথ তো এ সব কিছুর মধ্যেই প্রাণের রস খুঁজে পেয়েছিলেন। আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু বিগত কয়েক দশক জুড়ে ইংরেজ বনিকের মানদন্ড থেকে পরিণত হয়েছিল শসকের রাজদন্ডে। এবং তাদের অত্যাচার পৌঁছে ছিল অসভ্যতায়। তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বললেন, ‘অধর্মের দ্বারা মানুষ বাড়িয়া ওঠে, অধর্ম হইতে সে আপন কল্যাণ দেখে, অধর্মের দ্বারা সে শত্রুদিগকে জয় করে; কিন্তু পরিশেষে একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায়।’
রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন বাস্তববাদী তেমনি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ধংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি স্বপ্ন দেখে ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল বিশ্বযুদ্ধের এই রক্তফাটা মাটি থেকেই আত্মপ্রকাশ করবে নতুন সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যত দেখতে পেতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবন তাকে আর বেশি সময় দেবে না। ‘এরকম একটি সময়ে শন্তিদেব ঘোষ আসন্ন নববর্ষের প্রভাতে গাইবার জন্য একটি নতুন গানের আবদার করলেন কবির কাছে। এই সময়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাবীও ছিল মানবের জয়গান গেয়ে একটি কবিতা লিখে দেয়ার। বাসভবন উদয়নে বসে সদ্য লেখা সেই কবিতাতেই সুরারোপ করলেন রবীন্দ্রনাথ’। স্বরলিপি করে দিলেন শান্তিদেব ঘোষ। ভৈরবী আঙ্গিকের গান শান্তিনিকেতনের সকালের প্রথম প্রহর মুগ্ধ হয়ে শুনছে- যে ভোর নবজীবনের বোধন গাইছে ঐ মহামানব আসে...। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ও বৈশাখ যেন একাকার হয়ে যায়।
চারপাশের স্থায়ী ধ্বংস। এক সময় যে ইউরোপকে অধুনিক সভ্যতার দূত মনে করেছিলেন সেই সভ্যতার রক্তমাখা রূপ দেখে সকলের মতো রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসেও টোল খেয়েছিল। কিন্তু তিনি তো কবি- জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির হৃদয়ে পাতাঝরা ডালের কচি সবুজ পাতার মতো তিনি আবিষ্কার করেছেন আত্মবিশ্বাসকে।
নববর্ষের অভিভাষণে ‘সভ্যাতার সংকট’ এ তিনি লিখছেন “জীবনের প্রথম-প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্চিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম অশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব-দিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি- পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যাতাভিমানের পরিকীর্ন ভগ্নস্তুপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।”
জীবনের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে রচনা করে ছিলেন আরও একটি গান। ‘হে নতুন দেখা দিক আরবার’
তথ্যগত দিক থেকে এইটিই তাঁর শেষ গান। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতার একটা অংশকে সামান্য বদলে সুর দিয়েছিলেন তিনি। ‘হে নূতন/ তোমার প্রকাশ হোক কুজ্জটিকা করি উদ্ঘাটন/ সূর্যের মতোন।’
আজ এই মহামারি কালে, এই মৃত্যুপোড়া দেশে- চৈত্র-বৈশাখ আরও নিষ্ঠুর হয়ে দহন করছে আমাদের। চারিদিকে যখন করোনার ভয়াবহতা অবধারিত। আবার অনেক ক্ষেত্রে করোনায় শারীরিক যত না প্রয়োজন মানসিক চিকিৎসা ঢের বেশি জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সময়ে তরুণ ছেলে-মেয়েরা পরম যত্নে লড়ে যাচ্ছে, বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে অপরিসীম সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে। বহু চিকিৎসকই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন রোগিদের সুস্থ করার জন্য, যা কঠিন অন্ধকারেও আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলছে।
দহন জুড়োতে আসবে নিশ্চয়ই বর্ষা। হয়তো ‘সমুখে শান্তিপারাবার।’ কবি যেমন করে বৈশাখে স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের মৃত্যুর পরেও মানবের থেকে যাওয়ার কথা। সেই নূতন মানবই রবীন্দ্রনাথের কাঙ্খিত মহামানব। সেই মানুষই আছে আমাদের এই মানুষের মধ্যেই।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো .... এ গান গাইবার জন্য আজ সকালে রমনার বটমূলে কিংবা জনসমাগমে গিয়ে গাইবার কিংবা শুনতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ঘরে বসেই প্রর্থনার মতো করে গাইবো-
প্রকৃতির মধ্যে মানব মনের যে যোগাযোগ বা মিলন সেটিই কবি প্রকাশ করেছেন তাঁর গানে। কত যুগের কত গ্লানি, কত পুরাতন স্মৃতি, কত জরা-জির্নতা, কত দুঃখ-বেদনা এই বৈশাখের দারুণ অগ্নিবানে মুছে গিয়ে আসুক নতুন দিন। এই বৈশাখে নতুন একটা জীবন চাই যে জীবন নির্মল-সুন্দর-ভালবাসাময়।
লেখক: শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : রবীন্দ্রনাথ বৈশাখ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh