স্বাধীনতার চেয়ে সুন্দর কিছু হয় না

সাহিত্যের সামান্যতম মনোযোগী পাঠকমাত্রই জানেন যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানেন, কমিউনিস্ট পার্টি অন্য দশটি পার্টির মতো নয়। এটি রেজিমেন্টেড একটি দল। এই পার্টির সদস্যদের ব্যক্তি, সমাজ, কর্ম ও সাংগঠনিক জীবনে অনেক নিয়ম-কানুন কড়াকড়িভাবে মেনে চলতে হয়।

একজন বড় মাপের সৃষ্টিশীল লেখক বা শিল্পী যে কোনো নিয়মাচারের ব্যবস্থাপত্র মেনে জীবনযাপন করবেন, তা চিন্তা করাই কঠিন। তবু বাঙালি লেখক-কবিদের অনেকেই এবং বহির্বিশ্বের অনেক বড় লেখক ও শিল্পী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পাবলো পিকাসো, পাবলো নেরুদা ও হাওয়ার্ড ফাস্টসহ অনেকে ছিলেন। জাঁ পল সার্ত্র-ও অনেক বছর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিজীবনের অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ হচ্ছে, মার্কসবাদের মধ্যেই সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা অনেকখানি প্রযোজ্য। তিনি পার্টির সিদ্ধান্ত মেনেই কাজ করতেন। পার্টি তাঁর কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে দিয়েছিল লেখক-শিল্পী ফ্রন্টে। প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

তবে পার্টির সাংগঠনিক শৃঙ্খলা মেনে চললেও, তাঁর ভেতরে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, যখন পার্টি সাহিত্যক্ষেত্রে লেখক-কবিরা কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন, কোন লেখকের সাহিত্যকে কোনভাবে বিচার করবেন- এই ধরনের একটি বাঁধা পথ তৈরি করে দিতে চাইছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন উদ্ভাবিত হয়েছে সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্ব, প্রচার করা হচ্ছিল। স্বয়ং ম্যাক্সিম গোর্কি এই তত্ত্বের প্রণেতা। (যদিও তথ্যটি সঠিক নয়। ঝদানভ নামক একজন তাত্ত্বিকের দলিল ছিল সেটি। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখক সংঘের সভাপতি তখন ছিলেন গোর্কি। তার গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান রাশিয়া তো বটেই, সারাবিশ্বেই অনেক বেশি। তাই সোভিয়েত নেতারা এই দলিলকে গোর্কির নামেই চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন)। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্বকে গ্রহণ করলেন, তার সপক্ষে প্রচার চালালেন এবং পার্টির সদস্যভুক্ত সব লেখক-কবি-শিল্পীকে সেই তত্ত্ব মেনে লেখালেখি করার জন্য অনুরোধ জানালেন। কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর অনুরোধ মানে অলঙ্ঘনীয় আদেশই প্রায়। সাংগঠনিক নিয়মের কারণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে এই নীতির বিরোধিতা করেননি (পার্টি ফোরামে করেছিলেন কি-না জানা যায়নি)। তবে তাঁর মনে যে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, তা পাওয়া যায় ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। আবার লেখালেখি বা সাহিত্যবিচারের সময় তিনি যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নির্দেশনাগুলোকে খুব একটা প্রয়োগ করেননি, সেটিও সেই সময়কার লেখা গল্প-উপন্যাস থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়।

প্রশ্নটা এখানেই।

যে কার্ল মার্কস মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন লড়াই করেছেন, সাহিত্য এবং শিল্পের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, যে মার্কসকে স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য মূল্য দিতে হয়েছে জীবনভর, সেই মার্কসের অনুসারীরা কীভাবে সাহিত্য ও শিল্পের জন্য একটি ছক নির্ধারণ করে দেয়? সত্য ও স্বাধীন মত প্রকাশের অপরাধে বারবার মার্কসের পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়েছে, তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে বারবার, একদেশ থেকে তাড়িয়ে তাকে আরেক দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার রুটি-রুজি উপার্জনের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন- ‘স্বাধীনতা মানুষের স্বরূপলক্ষণ; আগন্তুক ধর্ম নয়।’ তিনি বেঁচে থাকলে কি এমন একটি দেশকে সমাজতান্ত্রিক দেশ বলতেন, যে অন্য কারও মত প্রকাশের বা ভিন্নমত প্রকাশের বিন্দুমাত্র সুযোগ রাখে না? এই কাজটিও করা হয়েছিল মার্কসের দোহাই দিয়েই। মার্কসের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভরে রাখা হয়েছিল সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার দলিলটিকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর মতো অনেকেই এই তত্ত্বটি একদিকে মানসিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না, আবার এই তত্ত্বেও সমর্থনে মার্কসের বক্তব্য এতে জুড়ে দেওয়ার কারণে দলিলটিকে ছুড়ে ফেলতেও পারছিলেন না।

এটি কীভাবে ঘটেছিল? ঘটেছিল এই কারণে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মার্কস-এঙ্গেলসের যেসব রচনাবলি ছেপে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হতো, সেগুলো ছিল লেনিন এবং স্টালিনের অনুসারীদের দ্বারা সম্পাদিত। মার্কস ও এঙ্গেলসের সাহিত্য এবং শিল্প সম্পর্কিত রচনাগুলো সহজলভ্য ছিল না। ভারতে তো দূরের কথা, জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতেও সেগুলো পাওয়া যেত না। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা সেগুলো প্রকাশের ও প্রচারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেক পরে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে সেসব রচনা, বিশেষ করে ‘তরুণ মার্কস’-এর রচনা ও চিঠিপত্র মানুষের গোচরে আসে। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কসের সুস্পষ্ট মতামত সেই রচনাগুলোতেই রয়েছে। কারণ ওই সময়টিতেই মার্কস সাহিত্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ পেয়েছিলেন।

তার কাছের মানুষদের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জেনেছি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের রচনার নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন মার্কস। শেক্সপিয়ারের রচিত নাটকের স্তবকের পর স্তবক মুখস্ত বলতে পারতেন তিনি। বিভিন্ন রচনায় ব্যবহার করেছেন শেক্সপিয়ারের উদ্ধৃতি। বালজাকের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধিতা করতেন মার্কস; কিন্তু বালজাকের উপন্যাসগুলো ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। জার্মানভাষার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ কবি হাইনরিখ হাইনে ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। এই কবি ছিলেন মার্কসের মতবাদ সম্পর্কে একেবারেই অনাগ্রহী। তার কন্যারা এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে মার্কস বলেছিলেন- বড় কবিদের কোনো মানদণ্ড দিয়ে মাপতে চাওয়া ঠিক নয়। 

বলশেভিক বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই বিপ্লব টিকিয়ে রাখার জন্য লেনিনকে অনেক কিছুই করতে হয়েছিল পরিস্থিতির চাপে। যেহেতু মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক সফল বিপ্লবের পরে সেই রাষ্ট্রের রূপরেখা সম্পর্কে কিছু বলে যাননি, তাই লেনিনকেই খুঁজে বের করতে হয়েছে পথচলার দিক-নির্দেশনা। সেই পথে কী কী ভুল ছিল বা কী কী সঠিক ছিল, তা অন্য আলোচনার বিষয়। তা নিয়ে হাজার হাজার বই ইতিমধ্যে লিখিত এবং প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখানে বলতে চাই, সাহিত্যের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মার্কসের আপসহীন অবস্থানের কথা। আমরা দেখতে পেয়েছি, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রহণ করেও শিল্প-সাহিত্য-ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা নিয়ে লেখক-শিল্পীদের নিজেদের মধ্যেই যে মানসিক অস্বস্তি ছিল, তার সঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তার সাযুজ্য কতখানি? এখন দেখা যাচ্ছে সাযুজ্য নেই। 

শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, মাকর্সের সব চিন্তার মূল বিষয় ছিল- প্রতিটি মানুষের জন্য চূড়ান্ত স্বাধীনতা। সীমান্তহীন এবং মুক্তির আনন্দমণ্ডিত স্বাধীনতা। মার্কস বারবার জানিয়ে গেছেন পরিপূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে সুন্দর মানুষের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। সুন্দর স্বাধীন সমাজ সম্পর্কে মার্কসের চিন্তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয়হীন পণ্ডিতরা মার্কসবাদকে নিছক ‘ইকনোম্যানিয়া’ আখ্যা দিতে পছন্দ করেন। এখন আমরা বলতে পারি, তাঁরা যে শুধু মার্কসবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ তাই নয়, বরং মানুষের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ধারণা সম্পর্কেও অজ্ঞ। এমনকী মানুষ যে কোনোদিন পরিপূর্ণ স্বাধীন হতে পারে, সেই চিন্তাটিতেই তাদের আস্থা বা বিশ্বাস নেই।


সুন্দরকে কি সবাই দেখতে পায়?

উত্তর দিয়ে গেছেন আমাদের শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলিতে- ‘সেই বেজান্ শহরের কথা মনে হয়; উপবনে সেখানে পাখি গাইলো ফুল ফুটলো, মুকুল খুললো, ফল ধরলো, পাতা ঝরলো, সবই সুন্দরভাবে হয়ে চললো দিনে রাতে; কিন্তু শহরের মানুষ এগুলো থেকে কিছু নিতে পারল না, পাথরের চেয়েও পাথর হয়ে ব’সে রইলো, শুধু দু-চারজন পথিক দু-একটি হতভাগা ভিখারী নয়, পাগল তারাই কেবল থেকে থেকে এলো-গেলো। সেই দেশের সেই বাগানে যেখানে দৃষ্টি-ভোলানো সুন্দরের সামনে মুখ করে বসে আছে মুক বধির নিশ্চল মানুষের দল ঘোলা চোখ মেলে।’ [বানানরীতি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব]।

সংগীতকে উদারণ হিসেবে গ্রহণ করে প্রায় একই রকম কথা পাই মার্কসের পাণ্ডলিপিতে আছে এভাবে- ‘গান যে-রকম মানুষের শুধু সাংগীতিক বোধই জাগায়, এবং বেসুরো কানের কাছে যেমন সূক্ষ্মতম সংগীতের আবেদনের অভাব গ্রাহ্য বিষয় নয় (কারণ আমার গ্রাহ্য বিষয় তো আমার অন্তর্লীন সামর্থ্যরেই স্বীকৃতি, আর এ-বিষয়ে আমার অধিকার ততখানিই আমার অন্তর্লীন অধিকার যতখানি) এবং যেহেতু আমার মধ্যে গ্রাহ্য বিষয়বোধ ততদূরই এগোয় যতদূর আমার ইন্দ্রিয়চেতনা যেতে পারে। ঠিক তেমনই সামাজিক মানুষের বোধ অসামাজিক মানুষের বোধ থেকে আলাদা হয়ে যায়।’

এটিই বাস্তব। সুন্দরকে দেখার চোখ সবার থাকে না। সুন্দরকে দেখতে হলে মানুষকে অনুশীলন করতে হয়, সুন্দরকে দেখার উপযুক্ত করে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।

কার্ল মার্কস সেই স্বপ্নটাই দেখেছিলেন। পৃথিবী নামের এই গ্রহবাসী সবাই সুন্দরকে দেখার অধিকার এবং শিক্ষা লাভ করবে, সবাই উপভোগ করতে পারবে ইস্কাইলাস, হোমার, শেক্সপিয়ারের ধ্রুপদী রচনার সৌন্দর্য, বিঠোফেন-বাখ-মেনুহীমের সুরের উচ্ছ্বাস মেখে নিতে পারবে নিজের সত্তায়, উপভোগ করতে পারবে প্রকৃতির রূপ-রস-নির্জনতা-দলবদ্ধ আনন্দসম্মেলন। পৃথিবীর সব মহৎ সাহিত্য, মহৎ শিল্প উন্মুক্ত হয়ে যাবে সবার জন্য।

সাম্যবাদকে মার্কস গ্রহণ করেছিলেন ‘স্বাধীনতার’ অর্থে। ‘ইকনোমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস অব ১৮৪৪’ ও ‘জার্মান আইডিয়োলজি’ বই দুটিতে সাম্যবাদী সমাজের যে স্নিগ্ধ চিত্র মার্কস এঁকেছেন তা একসঙ্গে সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়- ‘সেই সমাজ নিপীড়নহীন, স্বাধীন, প্রবুদ্ধ মানুষের স্বতঃপ্রণোদিত সহযোগিতায় গড়ে ওঠা অভিনব সমাজ। সেই সমাজে শোষণ নেই, পরবশ্যতা নেই, শ্রমবিভাগের গ্লানি নেই, নেই লোভ ও টাকার দাসত্ব, অর্থগৃধ্নুতা। সমষ্টিতন্ত্রের যুপকাষ্ঠে ব্যক্তিমানুষকে বলি দেওয়া হয় না সেখানে। পূর্ণতার সাধনায়, মানবধর্মের সাধনায় সবাই সেই সমাজে আনন্দযোগে নিযুক্ত।

মার্কসের জীবদ্দশায় ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের অবস্থা কেমন ছিল? সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেই সময় এবং মানুষের মানসিক অবস্থাকে তুলে ধরেছেন যেভাবে, সেটাই ধার হিসেবে নিচ্ছি আমরা- ‘কী সে চায় মানুষ নিজেই তা জানে না। অথচ ক্ষ্যাপার মতো সে পরশপাথর খুঁজে বেড়াচ্ছে। জীবনবিমুখতা, অস্থিরতা, আত্মিকবোধহীনতা মানুষকে আজ নৈরাশ্যপীড়িত করে তুলেছে। নীটশের ভাষায় মানুষের জগতে ঈশ্বর আজ মৃত। ফলে জগত আজ উন্মুক্ত প্রকাশিত, ভাগবত-সুষমা বঞ্চিত। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ-অনুভবের দিক থেকে জগত পুরোপুরি নিরপেক্ষ। গ্রিক যুগে বা রেনেসাঁসের আমলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে আত্মিক যোগ ছিল, সেই যোগ আজ ছিন্ন। সবমিলিয়ে মানুষ এই জগতে আজ পরবাসীর মতো। মানুষ আজ আত্মচ্যূত, বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, একাকী।’ [‘এক্ষণ’। কার্ল মার্কস বিশেষ সংখ্যা। পৃষ্ঠা ১৩৬]। তুলনীয় আমাদের এখনকার সমাজও প্রায় একই রকম বিভ্রান্ত ও বিবমিষায় আক্রান্ত।

মার্কস সেই সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কারণ সেই সমাজ মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ দেবার পরিবর্তে, তাকে আরও অবদমিত করে রাখছে। মানুষের কোনো স্বাধীনতা বা সুযোগ নেই নিজের সৃষ্টিশীলতা অনুশীলনের। শ্রমের সঙ্গে আদিম মানুষের শিল্পসৃষ্টির ভূমিকা থাকলেও, আধুনিক মানুষের সৃষ্টিশীলতার জন্য দরকার হয় উপযুক্ত অবকাশের। যে মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যে মানুষকে পরিবারসহ বেঁচে থাকার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা যুদ্ধ করতে হয়, সে শিল্প উপভোগ বা সৃষ্টির সুযোগ পাবে কীভাবে? জীবন বাঁচানোর জন্য, পরিবারকে বাঁচানোর জন্য মানুষকে কাজ করতেই হয়। এটি তার জৈবিক উদ্দেশ্য পূরণ করে; কিন্তু শুধু জৈবিক উদ্দেশ্য পূরণ করাটিই একমাত্র লক্ষ্য হলে মানুষের সঙ্গে অন্য কোনো প্রাণীর মোটেই পার্থক্য থাকে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ করার মাধ্যমেই মানুষ শিল্প সৃষ্টি করে। অর্থাৎ শিল্প বা সাহিত্য হচ্ছে ‘অপ্রয়োজনের সৃষ্টি’। এই বাড়তি সৃষ্টিই মানুষকে আলাদা করেছে অন্যসব প্রাণী থেকে। দেয়ালে বা উঠোনে আল্পনা আঁকা কোনো বৈষয়িক বা জৈবিক প্রয়োজন মেটায় না। কবিতা কোনো বৈষয়িক উদ্দেশ্য পূরণ করে না। বাড়ির এক টুকরো আঙিনার একপাশে কয়েকটা ফুলের চারা মানুষকে বাড়তি আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেয় না। আলাউদ্দিন খাঁর সেতারবাদন বা বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনতে যে সময় মানুষ ব্যয় করে, তা থেকে কোনো অর্থমূল্য উৎপাদিত হয় না; কিন্তু সেগুলো সবই জীবনকে সুন্দর করে। কারণ সেগুলো সুন্দর।

এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন যথারীতি রবীন্দ্রনাথ। সৌন্দর্যবোধ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন- ‘অনিবার্য প্রয়োজনের মধ্যে মানুষের একটা অবমাননা আছে; কিন্তু সৌন্দর্য নাকি প্রয়োজনের বাড়া, এই জন্য সে আমাদের অপমান দূর করিয়া দেয়। সৌন্দর্য আমাদের ক্ষুধাতৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা একটা উচ্চতর সুর লাগাইতেছে বলিয়াই, যাহারা একদিন অসংযত বর্বর ছিল তাহারা আজ মানুষ হইয়া উঠিয়াছে, যে কেবল ইন্দ্রিয়েরই দোহাই মানিত, সে আজ প্রেমের বশ মানিয়াছে। আজ ক্ষুধা লাগিলেও আমরা পশুর মতো, রাক্ষসের মতো, যেমন-তেমন করিয়া খাইতে বসিতে পারি না, অতএব, আমাদের খাইবার প্রবৃত্তিই একমাত্র নহে, শোভনতা তাহাকে নরম করিয়া আনিয়াছে।’

একই প্রসঙ্গে মার্কসের ম্যানুস্ক্রিপ্টে পাওয়া যাচ্ছে- ‘পশুরা নিজেদের সন্ততিকুলের অব্যবহিত প্রয়োজনবোধ মেটাতে কিছু তৈরি করে, তারা একদিক-ঘেঁষা জিনিস তৈরি করে; মানুষ করে নিখিল অর্থে; পশুরা শুধু অব্যবহিত প্রয়োজনের বশ্যতা মেনে তৈরি করে, যেখানে মানুষ জৈব প্রয়োজন নিরপেক্ষ হয়ে সৃষ্টি করে, এবং তখনই যথার্থ সৃষ্টি করে যখন সে ঐ প্রয়োজনসমূহ থেকে মুক্ত।’

এই শিল্পসৃষ্টি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সামাজিক মানুষ হয়েও যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানুষের অধিকার এবং অপরিহার্য সাধনার বিষয় সে বিষয়ে মার্কসের অসাধারণ বৈপ্লবিক মন্তব্য- ‘পঞ্চেন্দ্রিয়ের গঠনকালের পিছনে অনাদিকাল থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত জগতের ইতিহাস নিহিত রয়ে গেছে। স্থুল জৈব প্রয়োজন দ্বারা বদ্ধ ইন্দ্রিয়ের তাৎপর্য অত্যন্ত সংকীর্ণ। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে খাদ্যের তো কোনো রূপই নেই, আছে শুধু তার অবিচ্ছিন্ন সারবস্তু। স্থুলতম চেহারা নিয়ে তা হয়তো হাতের কাছে লভ্য হতে পারে এবং এ কথা নির্ধারিতরূপে বলা শক্ত কোথায়? বুভূক্ষু মানুষের আহারের সঙ্গে পশুর খাদ্যগ্রহণের তফাৎ রয়েছে। ক্লিষ্টকাতর দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষের পক্ষে সূক্ষ্মতম নাট্য-আস্বাদন সম্ভব নয়; ধাতুব্যবসায়ী শুধু বাজারদর বোঝে, জানে না ধাতুর মৌলতা, সৌন্দর্য। তার কোনো খনিজ বোধভাষ্য নেই। তাই তো থিয়োরিগত ও বস্তুগত অর্থে মানুষের অনাত্মীকরণ বা অবজেটিভাজেশন প্রয়োজন, প্রয়োজন সেই মাধ্যমের যা মানব-ইন্দ্রিয়কে মনুষ্যজীবন ও প্রকৃতির ঐশ্বর্যের সমানুপাতে মানবিক করে তোলে।’

কার্ল মার্কস বর্তমানের সমাজের উচ্ছেদ চান। কারণ এই সমাজ সিংহভাগ মানুষকে সুন্দরের সাধনা এবং সুন্দরের উপভোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখে। এই সমাজে মানুষ শ্রমবিভাজনের, পুঁজির, সামাজিক বিভিন্ন ভেদরেখার কাছে বন্দি, তার কর্মের স্বাধীনতা নেই, তার মতামতের কোনো দাম নেই, তার প্রতিবাদেরও কোনো অধিকার নেই। তার শিক্ষার সুযোগ নেই, নিজের মনের মতো কর্ম খুঁজে নেবার সুযোগ নেই, তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনো উন্নত জীবন রেখে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই মানুষ কীভাবে উপভোগ করতে পারবে সৌন্দর্যকে? কীভাবে উন্মোচিত করতে পারবে নিজের শিল্পীসত্তাকে? 

মার্কসের বিরোধীরা প্রচার করে যে, মার্কসবাদে ব্যক্তির কোনো স্থান নেই। অথচ মার্কসের কোনো লেখাতে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মার্কস কখনোই বলেননি যে, সমাজের স্বার্থে ব্যক্তিকে আত্মবলিদান করতে হবে। বরং চেয়েছেন প্রতিটি ব্যক্তির যথার্থ বিকাশ এবং সেজন্যই প্রয়োজন এমন একটি সমাজব্যবস্থা নির্মাণ করা, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগের নিশ্চয়তা থাকবে। সেই সমাজটি সাম্যবাদী সমাজ। আর সমাজতন্ত্র হচ্ছে- সাম্যবাদে পৌঁছানোর একটি ধাপ, যেখানে মানুষ ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের অনুশীলন করবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে নানা কারণে এই অনুশীলনের ব্যত্যয় ঘটেছিল। তার জন্য মার্কসকে দায়ী করার কোনো কারণ নেই। কারণ মার্কসের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলো আমাদের জানাচ্ছে- ‘মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের, সংবাদপত্রের, শিল্পের ও সাহিত্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য মার্কস আজীবন লেখালেখি করেছেন এবং সংগ্রাম করেছেন। সুতরাং মার্কসবাদের নামে সাহিত্যের ওপর সেন্সর আরোপের কোনো প্রশ্নই আসে না।

মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর অন্যতম প্রধান পার্থক্যের সূচক হিসাবে মার্কস শিল্পসৃষ্টিকে চিহ্নিত করেছেন। সাহিত্যসৃষ্টিকে উচ্চতম মানবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে বারবার উল্লেখ করেছেন, সাহিত্য ও শিল্প যেহেতু প্রয়োজন-নিরপেক্ষ, সেই কারণে তা সৃষ্টিগতভাবেই স্বাধীন। স্বাধীন তার স্রষ্টাও। প্রতিটি মানুষকে স্রষ্টার ভূমিকায় দেখতে চান মার্কস। তার জন্য দরকার এমন একটি সমাজ যেখানে সব মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিক এবং সৃষ্টির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সেই সমাজ সৃষ্টির জন্যই বিপ্লব প্রয়োজন। তাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় প্রত্যাশা করা হয়- ‘শিল্পসাহিত্য বিপ্লবকে দেবে ভাষা; আর বিপ্লব শিল্প-সাহিত্যকে দেবে মুক্তি।’  

লেখক : কথা সাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //